বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহত বাড়ছে, প্রতিদিন গড়ে ১৪ জনের মৃত্যু

জিন্নাতুন নূর

সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রণয়ন বা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কোনো কিছুতেই থামছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। আর সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। দেশে এখন প্রতিদিন গড়ে ১৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। এর মধ্যে দুজনেরও বেশি মানুষ মোটরসাইকেল চালক বা আরোহী। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর ১১ বছরের (২০১২-২২) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩ হাজার ৮৯৬ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে অন্তত দুজন শিক্ষার্থী মারা যাচ্ছে। দুর্ঘটনায় ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করছেন। তবে সড়ক দুর্ঘটনা যে শুধু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তাই নয়, দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির পরিবারকে বাকি জীবন সহ্য করতে হচ্ছে নিদারুণ কষ্ট। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতেও।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) এর হিসাব বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। এ সংস্থাটির তথ্যে, বাংলাদেশে যানবাহনের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে বাংলাদেশে বছরে মৃত্যু হয় ৪৫টি। আর ভারতে এই হার ১০ দশমিক ২টি। যদিও এই হিসাবে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলের ফলে সৃষ্ট যানবাহনের তথ্য ধরা হয়নি।

নিসচার মতে, ২০২২ সালে দেশে ৫ হাজার ৭০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।

এতে মারা যায় ৫ হাজার ৭৬০ জন। যা সড়কপথে ২০২১ সালে মৃত্যুর চেয়ে ২ হাজার ৪১৫ জন বেশি। তবে এ তথ্য একেক সংস্থার কাছে একেক রকম। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যে, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ৬ হাজার ৫৪৮ জনের। আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে,  একই সময়ে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জনের মৃত্যু হয়।

সড়ক দুর্ঘটনার বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, ওভারটেকিংয়ের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, খানাখন্দে ভরা সরু পথ, ত্রুটিপূর্ণ সেতু, চালকের মাদক সেবন, ট্রাফিক আইন না মানাসহ দুর্ঘটনার আরও অনেক কারণ আছে। রাজধানীর ইস্কাটন টাওয়ারের সামনে গত ৭ নভেম্বর রাতে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি আরিফুল ইসলাম ও ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক নেতা সৌভিক করিম অর্জুনের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। বাংলামোটর থেকে মগবাজারের দিকে মোটরসাইকেলে যাওয়ার পথে ট্রাকচাপায় ঘটনাস্থলে এই দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়। ট্রাকটি পরে মগবাজারের দিকে পালিয়ে যায়।  

দেশের মোট রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৬টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৫টি। এ হিসাবে মোট যানবাহনের ৭২ শতাংশের বেশি মোটরসাইকেল। গত পাঁচ বছর রাজধানীতে দুই চাকার এ যানবাহন বেড়েছে অন্তত ১০ লাখ। সড়কে ৫০ শতাংশের বেশি মৃত্যু হচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে। গত অক্টোবর মাসে সারা দেশে ৪২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন আরও ৬৮১ জন। নিহতদের মধ্যে এক- তৃতীয়াংশ মোটরসাইকেল আরোহী। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্যে এমনটি জানা যায়। এতে বলা হয়, অক্টোবরে বাংলাদেশে ১৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৪ মোটরসাইকেল আরোহীর প্রাণ যায়। আহত হয়েছেন ৭৬ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার এ সংখ্যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩১ শতাংশ আর এতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৩ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি। তাদের মতে, মহাসড়কগুলোতে দূরপাল্লার বাহন হিসেবে এখন মোটরসাইকেল এবং থ্রি-হুইলারের মতো যান চলাচল বৃদ্ধির জন্য সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার প্রাইভেট কারের তুলনায় অটোরিকশা, ইজিবাইক ও থ্রি-হুইলারের দুর্ঘটনার তিন গুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে ঘটছে তা যদি চলতেই থাকে তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জিত হবে না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভারী যানবাহনের মধ্যে সম্প্রতি ট্রাক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার গত এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ থেকে সড়কে নৈরাজ্য বাড়বে, আর নৈরাজ্য বৃদ্ধি পেলে সড়ক দুর্ঘটনাও বৃদ্ধি পাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর