শিরোনাম
শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চতুর্মুখী প্রতারণার জাল

শামীম আহমেদ

চতুর্মুখী প্রতারণার জাল

চুরি হচ্ছে আঙুলের ছাপসহ ব্যক্তিগত তথ্য। একজনের বায়োমেট্রিকে সিম তুলছেন আরেকজন। অন্যের নামে অ্যাক্টিভেট করা সিম ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের দায় চাপছে নিরপরাধ ব্যক্তির কাঁধে। টেলিগ্রাম অ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপে এনআইডি নম্বর দিলে চলে আসছে রাষ্ট্রের কাছে সংরক্ষিত ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত সব তথ্য। ফেসবুকে ভুয়া ই-কমার্স পেজ খুলে লোভনীয় অফার দিয়ে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য দিচ্ছে একশ্রেণির প্রতারক। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে খালি করা হচ্ছে মানুষের পকেট। ডাব খাইয়ে অচেতন করে ঘটছে ছিনতাই। চিকিৎসা করাতে বা চাকরি খুঁজতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ। জিনের বাদশা সেজে বা গুপ্তধন পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বিকাশ বা নগদে টাকা নিচ্ছে প্রতারক চক্র। চতুর্মুখী প্রতারণা জালে নাজেহাল মানুষ। অধিকাংশ প্রতারণায় মোবাইল নম্বর ব্যবহৃত হলেও অধরাই থাকছে অপরাধীরা।

পুলিশ বলছে, অনেক অপরাধীর মোবাইল নম্বর, বিকাশ বা নগদ নম্বরের সূত্র ধরে ব্যক্তিকে আটকের পর দেখা যাচ্ছে ওই সিমটি তার নামে নিবন্ধিত তা তিনি জানেনই না। এমনকি যিনি মাত্র দুটি সিম কিনেছেন, তার এনআইডির বিপরীতে রয়েছে ১০টি। সম্প্রতি সিম জালিয়াত চক্রের আট সদস্যকে আটকের পর তাদের কাছে সিলিকন পেপারে সংরক্ষিত হাজার হাজার মানুষের আঙুলের ছাপ পায় গোয়েন্দা পুলিশ। ওই ছাপ ব্যবহার করে তারা নতুন সিম নিবন্ধন করতেন। সেসব প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিম কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করতেন অপরাধ জগতে। তাদের একজন বানিয়েছিলেন একটি বিশেষ অ্যাপস। যার মাধ্যমে সিমের বায়োমেট্রিকসহ বিভিন্ন তথ্য টাকার বিনিময়ে তুলে দেওয়া হতো বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে। নাম, মোবাইল নম্বর বা এনআইডি নম্বর দিলেই তিনি বের করে ফেলতে পারেন ব্যক্তির সব তথ্য। পুলিশ জানায়, তাদের ছয়জনই দুটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার ও বিক্রয় প্রতিনিধি। সিম রেজিস্ট্রেশনের সময় বায়োমেট্রিক ফিঙ্গার প্রিন্ট স্কানারে আঙুলের ছাপ দেওয়ার সময় আঙুলে ময়লা আছে বলে এক ধরনের সিলিকন পদার্থে ছাপ নিত। পরে তা আরেকটি সিলিকনে সংরক্ষণ করত। অন্যের নামে প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিমে বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হতো।

আঙুলের ছাপ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সিম নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এর ফলে মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক অপরাধ কমে যাবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের নামে নিবন্ধিত সিমগুলোর বেশির ভাগই ব্যবহার করছে অপরাধীরা। এর একটি বড় অংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট সিম জালিয়াত চক্রের  পাঁচজনকে আটকের পর তাদের কাছ থেকে ৫০৪টি সিম উদ্ধার করা হয়, যার সবটাতেই বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলা।

এদিকে ফেসবুকে মাত্র ১৫০০ টাকায় ল্যাপটপ, ১২০০ টাকায় বাইসাইকেল, ৮০০০ টাকায় ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল এমন অসংখ্য লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিকাশ বা অন্য কোনো এমএফএস অ্যাকাউন্টে অগ্রিম টাকা নিচ্ছে প্রতারক চক্র। লোভনীয় অফারটি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে পণ্যের মূল্যের একটি অংশ কোনো কিছু বিবেচনা না করেই অগ্রিম পাঠিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। পরে পণ্য আর মিলছে না। উল্টো ওই নম্বরে ফোন দিলে মিলছে অশ্রাব্য ভাষায় গালি।

দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা অনলাইনে কাজ করে মাসে ২০০০ থেকে ৮০০০ ডলার আয়ের স্বপ্ন দেখানো প্রচুর বিজ্ঞাপন কয়েক মাস ধরে ফেসবুকে ঘুরছে। বলা হচ্ছে, কাজ করতে হবে বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনে। বিজ্ঞাপনে অ্যামাজনের লোগোও ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনটি ইংরেজিতে হলেও সেখানে ফরম ফিলাপ করতে গেলে একটা পর্যায়ে অ্যাকাউন্ট করতে ৩০০-৫০০ টাকা বিকাশ করতে বলা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশি নম্বর। আবার কখনো লেনদেনের জন্য চাওয়া হচ্ছে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের তথ্য।  এদিকে গত বছর ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্রের (হ্যালো পার্টি) প্রধান কালামৃধা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রেজাউল মাতুব্বরসহ চার সদস্যকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ারের নম্বর ক্লোন করে ব্যাংক কর্মকর্তা পরিচয়ে গ্রাহকের কার্ডের তথ্য হাতিয়ে নিত তারা। এরপর ফাঁকা করত কার্ডে থাকা অর্থ। এক বছরের ব্যবধানে গত সেপ্টেম্বরে সেই ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকেই ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতিতে জড়িত আরও একটি চক্রকে আটক করে পুলিশ। চক্রটি মাত্র পাঁচ মাসে অন্যদের ক্রেডিট কার্ড থেকে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।

সর্বশেষ খবর