রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চ্যালেঞ্জ নির্বাচনি চাপমুক্ত অর্থনীতি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজের গতি বাড়িয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি অর্থের সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা, ডলার সংকটে দুই বছরে টাকার মান কমেছে ৩০ শতাংশ, গার্মেন্ট খাতের অস্থিরতা কাটিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পোশাকের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গৃহীত হলে রপ্তানি আয় বাড়বে

মানিক মুনতাসির

চ্যালেঞ্জ নির্বাচনি চাপমুক্ত অর্থনীতি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠ অস্থিতিশীল হয়ে উঠলেও প্রান্তিক পর্যায়ে টাকার প্রবাহ বাড়বে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে এক ধরনের উৎসব হিসেবেও দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব প্রকল্পের কাজ চলমান রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে অর্থের সরবরাহ, অর্থের প্রবাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। যার ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের গতিসঞ্চার হবে বলে মনে করে সরকার। যদিও করোনা মহামারির পর ঘুরে দাঁড়ালেও বৈশ্বিক চাপের কারণে স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধের কবলে পড়ে রীতিমতো উল্টোপথে হাঁটছে দেশের অর্থনীতি। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় অর্থনীতিতে অস্বস্তি সৃষ্টিকারী মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত বাড়ছে। ফলে বছর শেষে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে দেশে চলমান অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে সহিংস রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। নষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি খাত। সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে দফায় দফায়। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে দুই বছরে টাকার মান কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। যা এখনো অব্যাহত। খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১২৭-১২৮ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা গেছে। যা করোনা মহামারির মতো গভীর সংকটের সময়ও ৮৫ টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও থমকে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া দীর্ঘায়িত ডলার সংকটের কারণে শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি আমদানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে। এদিকে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতিও দুই অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই করছে প্রায় এক বছর ধরে। এ নিয়ে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক পৃথক পৃথক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন দিয়েছে। সংস্থা দুটি বলছে, মূল্যস্ফীতি কমানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই অর্থনীতিতে। ফলে চলতি বছরও বাজেটের প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। অন্যদিকে তৈরি পোশাক খাতের নতুন মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও তা প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। তবে কাজ নেই মজুরি নেই নীতি বাস্তবায়নের ফলে শ্রমিকরা আবার কাজে ফিরতে শুরু করেছেন। তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, গার্মেন্ট খাতের অস্থিরতা কাটিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পোশাকের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গৃহীত হলে রপ্তানি আয় বাড়বে। এতে অর্থনীতিতে নতুন করে গতিসঞ্চার হবে বলে তারা মনে করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক অসন্তোষ এড়াতে হবে। এমনিতেই দেশজুড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে অবরোধ-হরতাল, ভাঙচুর-আগুন অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতি চলে যাবে আরও গভীর সংকটে। যদিও মালিকরা বলছেন, নতুন মজুরি বাস্তবায়ন হলে শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নতি ঘটবে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান।  ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে দেশের বাজারেও। এমন অবস্থায় আমদানি মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোনোটাই বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকট বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আরও সংকটের দিকে নিয়ে গেছে। যার প্রভাবমুক্ত নয় বাংলাদেশও। তবে অতি সম্প্রতি রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে মনে করছে সরকার। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এ অবস্থায় সরকার চেষ্টা করছে গার্মেন্ট খাতের অস্থিরতা কাটিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পোশাকের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গৃহীত হলে রপ্তানি আয় বাড়বে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে বড় কাজ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার সরবরাহ বাড়ানো এবং রিজার্ভের পতন আটকানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান কমছে। এটাকে গিয়ারআপ করার জন্যও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক কোনো খবর আপাতত নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অব্যাহত ডলার সংকট সামষ্টিক অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলেছে। এ ছাড়া গার্মেন্ট খাতের অস্থিরতা রপ্তানি খাতে নতুন করে সংকটের সৃষ্টি করেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ তো আগে থেকেই চড়া। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও লেগেছে মন্দার ধাক্কা। খেলাপি ঋণ তো বাড়ছেই। রপ্তানি ও রাজস্ব আদায়েও তেমন কোনো সন্তুষ্টির খবর নেই। অন্যদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে খুবই কাছাকাছি। এ জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতাও বেড়েছে। দেশজুড়ে হরতাল-অবরোধও চলছে। জ্বালাও-পোড়াও পরিস্থিতি অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক তৈরি করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ থাকে। দেখা দেয় নানা ধরনের অনিশ্চয়তা। এ সময় বিনিয়োগকারীরা থাকেন পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়। বিদেশিরাও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধীরগতিতে চলেন। এদিকে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য চারটি কারণ দেখানো হয়েছে। সেগুলো হলো- দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি; দুর্বল মুদ্রানীতি; টাকার অবমূল্যায়ন; সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন এবং কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ। এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।

সর্বশেষ খবর