রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নাশকতা ঠেকাতে ব্যস্ত র‌্যাব পুলিশ বেপরোয়া মাদক কারবারিরা

সীমান্তবর্তী ১৪৬টি অরক্ষিত পয়েন্ট - রাজধানীতে ৩২১ স্পট, জমজমাট বেচাকেনা

সাখাওয়াত কাওসার

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বেপরোয়া মাদক ব্যবসায়ীরা। উৎসব আমেজে তারা রাজধানীসহ সারা দেশে মাদক ঢুকাচ্ছে। হরতাল ও অবরোধের আড়ালে দুর্বৃত্তদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের ব্যস্ত সময় পার করার কারণেই অনেকটা ফ্রি স্টাইলে মাদক মজুদের কাজটি করে যাচ্ছেন তারা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সীমান্তবর্তী ১৪৬টি অরক্ষিত পয়েন্ট চিহ্নিত করলেও তা বন্ধ করার বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই কর্তৃপক্ষের। পুলিশ সদর দফতরে দায়িত্বরত উপ-মহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, হরতালের নামে নাশকতাকারীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করলেও মাদক, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীসহ সব ধরনের অপরাধীদের ওপর আমাদের দৃষ্টি সরেনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে স্থল ও নৌপথে ৬৬টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ভয়ংকর মাদক আইস ও ইয়াবা। সীমান্তের অন্য পয়েন্টগুলো দিয়ে হেরোইন, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত-অপ্রচলিত মাদক আসছে। এই পয়েন্টগুলো দেশের ১৯টি সীমান্তবর্তী জেলার মধ্যে পড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, তারা হরতালের নামে নাশকতাকারীদের নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন। অন্যসব বিষয়ে নজর দেওয়ার সময়ও পাচ্ছেন না। ডিএনসির অতিরিক্ত মহাপরিচালক আজিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণই তো আমাদের কাজ। জনবলের অনেক স্বল্পতার পরও আমাদের সদস্যরা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করে আসছেন। গত কয়েকদিন ধরে সরেজমিনে রাজধানীর ধানমন্ডি লেক, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, হাতিরঝিল রামপুরা ব্রিজসংলগ্ন এলাকা, মিরপুরের পল্লবী এলাকার বিহারি ক্যাম্প ঢাকা মেডিকেল কলেজের আশপাশ এলাকা, কমলাপুর রেলস্টেশন-সংলগ্ন এলাকা, পুরান ঢাকার লালবাগ, সূত্রাপুর ও বুড়িগঙ্গার আশপাশের অন্তত ২৭টি স্পট ঘুরে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির চিত্র দেখতে পান এই প্রতিবেদক। তবে রাজধানীর ৫০টি থানার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি এলাকায়ই একাধিক স্পট রয়েছে। পুলিশই গত এক বছরে ৩২১টি স্পট চিহ্নিত করেছে। প্রতিদিন রাজধানীতে বিক্রি করা হয় প্রায় ১৬ লাখ ইয়াবা।

মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে দিনরাত চলছে মাদক বেচাকেনা। অন্তত ৩০ জনের নিয়ন্ত্রণে এখানকার মাদক কারবার। তেজগাঁও রেল বস্তি, বনানীর কড়াইল বস্তি, সবুজবাগের ওহাব কলোনি, কামরাঙ্গীরচর, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে মাদক বাণিজ্য চলে অর্ধশতাধিক মাদক কারবারির নিয়ন্ত্রণে। সম্প্রতি পল্লবী বিহারি ক্যাম্প এলাকায় ১৫ জন মাদক কারবারির সঙ্গে কথা হয়। তাদের একজন রাসেল (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, রাজধানীর বিহারি ক্যাম্পগুলোয় অন্তত ১৫টি গ্রুপ রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে মাদক কারবারিদের। স্থানীয় ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যও তাদের মাদক কারবারে সহযোগিতা করেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে ইয়াবা বেশি সেবন করা হয়। এর মধ্যে সারা দেশে প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি হয়। কেবল রাজধানীতেই বিক্রি হয় অন্তত ১৭ লাখ। প্রতিটি ইয়াবার দাম ৩০০ টাকা হলে ৭০ লাখ ইয়াবার দাম দাঁড়ায় ২১০ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকার সোর্সেরা সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত। পুলিশের গাড়িতে চলাফেরার কারণে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না সাধারণ মানুষ। অধিকাংশ সোর্সই মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত থাকায় একাধিকবার পুলিশের হাতে মাদকসহ আটক হয়েছেন। ভাটারা কুড়াতলি এলাকার রায়হান নামের এক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। গুলশান, বারিধারা, নিকুঞ্জ এলাকার মাদক ব্যবসার বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অন্তত ১৬টি মাদক মামলা আছে। ভাটারার বালুর মাঠ এলাকার মাদক ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রাজু ও তার স্ত্রী মেরী। এ দম্পতির বিরুদ্ধে ২২টি মাদক মামলা রয়েছে। রামপুরার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী জরিনা ওরফে জরি। তার নিয়ন্ত্রণাধীন সিন্ডিকেট এখনো খিলগাঁও ও রামপুরা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। উত্তরার সবচেয়ে বড় মাদকের ডিলার মনির ওরফে দাদা ভাই। বিভিন্ন শুটিং স্পটসহ অভিজাত পরিবারের সন্তানদের নিরাপদ আস্থার নাম দাদা ভাই। আগে ফেনসিডিল এবং ইয়াবার বড় ডিলার হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও গোয়েন্দারা বলছেন, বর্তমানে তার ডেরায় রয়েছে ক্রেজি ড্রাগস আইসের মজুদ। উত্তরা এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে মাসুদ ওরফে জামাই মাসুদের বেশ পরিচিতি রয়েছে। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী টঙ্গীর ব্যাংক মাঠের আফিয়া অনেক বড় ডিলার। খিলক্ষেত, ভাটারা এবং বাড্ডা এলাকার মাদক ব্যবসার বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন ফারুক ওরফে হাড্ডি ফারুক। হাড্ডি ফারুক ও এক সময় খিলক্ষেত থানার পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রকৃতপক্ষেই মাদক নির্মূল করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আর এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের আন্তরিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। ডিএনসি সূত্র জানায়, ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে অবগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সব সময়ই রহস্যজনক আচরণ তাদের। কারণ তাদের পৃষ্ঠপোষকদের অনেকেই সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তি। ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড, থানা বা মহানগর নেতা থেকে খোদ সংসদ সদস্য থেকে সিআইপি খেতাব পাওয়া ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মাদক নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকার খুব কাছে একটি বড় মাদকের হাব নারায়ণগঞ্জ। ডিমান্ড অনুসারে নারায়ণগঞ্জ থেকে মাদক সরবরাহ করা হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কারণ এই জেলার ওপর ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক গেছে। তাছাড়া ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের রয়েছে নৌ যোগাযোগ। সে কারণে ভারত সীমান্তবর্তী দুই জেলা কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে দেশে যেসব মাদক ঢুকছে, সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে এই জেলাকে ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হিসেবে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসা ইয়াবার চালানও এ জেলায় ঢুকছে। খোদ জেলা পুলিশের তালিকাতেই সাতটি থানা এলাকায় ৫২০ জন মাদক কারবারির নাম রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭৬ জন সদর থানা এলাকার। ফতুল্লা থানায় ১০৯ জন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ৯৯ জন, বন্দর থানায় ৬০ জন, রূপগঞ্জ থানায় ৩৮ জন, আড়াইহাজার থানায় ২১ জন এবং সোনারগাঁ থানায় ১৭ জন মাদক কারবারির নাম রয়েছে তালিকায়।

সর্বশেষ খবর