বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পথেঘাটে হাইড্রোজেন বোমা!

বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহত বাড়ছেই, হিলিয়ামের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ গ্যাস, নজরদারি বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের গুরুত্ব আরোপ

জিন্নাতুন নূর

পথেঘাটে হাইড্রোজেন বোমা!

আনন্দ উদযাপনে বা শিশুদের খুশি করতে ব্যবহৃত গ্যাস বেলুনে ক্রমেই আতঙ্ক বাড়ছে। কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সব বয়সী মানুষের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই দুর্ঘটনায় শিশুদের প্রাণহানির তালিকা উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম কম হওয়ায় নিরাপদ হিলিয়ামের পরিবর্তে কিছু বিক্রেতা নিষিদ্ধ হাইড্রোজেন গ্যাস বেলুনে ব্যবহার করায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এজন্য তারা এ ধরনের বেলুনের ব্যবহার বন্ধে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং এর বিক্রি বন্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নজরদারি বৃদ্ধিরও আহ্বান করেন।

ময়মনসিংহে ১৪ নভেম্বর গ্যাস দিয়ে বেলুন ফোলানোর সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১১ জন দগ্ধ হয়। নগরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে কালিবাড়ি দক্ষিণপাড়া এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ছয় শিশু ছাড়াও দুজন নারী ও তিনজন পুরুষ দগ্ধ হন। এর আগে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুর রূপনগরে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সাত শিশু মারা যায়। এ সময় আশপাশে থাকা আরও ২০ জন আহত হয়। গাজীপুরে পুলিশ লাইনসে গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণে দগ্ধ হন কৌতুক অভিনেতা আবু হেনা রনিসহ চার পুলিশ সদস্য। এর আগে গত বছরের ৯ জুলাই পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার বড়দীঘি বাজারে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে কিশোর বেলুন বিক্রেতা সোহাগ ইসলামের (১৫) মৃত্যু হয়। এ সময় লিমন নামে ১০ বছর বয়সী আরেক শিশু আহত হয়। এর আগে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া চৌরাস্তা বাজারে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বেলুন বিক্রেতা ইউনুস আলী নিহত হন। আহত হয় চার শিশু। গত বছরের ১৫ জুন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার শংকরদী গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় একটি ভোট কেন্দ্রের বাইরে বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে বেলুন বিক্রেতা জাহিদুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ সময় আহত তিন শিশুর একজনের হাসপাতালে মৃত্যু হয়। এছাড়া গত বছরের ১৫ মে রাজশাহীর বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে বেলুনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিনজন আহত হয়। একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে বেলুন বিক্রেতারা বেশি লাভের আশায় হিলিয়ামের পরিবর্তে দাহ্য হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করেন। সাধারণত বিক্রেতারা নিজেরাই সিলিন্ডারের ভিতর রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে এই হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করেন। আর অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে এই গ্যাস তৈরির প্রক্রিয়াটি ভয়ংকর। তারা জানান, হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে উড়ন্ত বেলুন তৈরির অনেক উপায় আছে। তবে এ দেশের বেশির ভাগ বিক্রেতা কস্টিক সোডা ব্যবহার করেন। কস্টিক পটাশের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়াম বা সিলভার মিশিয়ে তৈরি হয় গ্যাস। কোনো কোনো বেলুন বিক্রেতা কস্টিক সোডাও ব্যবহার করেন। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রচুর তাপ তৈরি হয়। রাসায়নিকের মিশ্রণটা পরিমাণমতো না হলে বিক্রিয়াটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। যার কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সাধারণত কারখানায় হাইড্রোজেন তৈরি করে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে সরবরাহ করার কথা থাকলেও অনেক সময় সিলিন্ডারের ভিতরেই হাইড্রোজেন তৈরি করে বেলুনে গ্যাস ভরা হয়। এতে সিলিন্ডার ফেটে গিয়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সাধারণত দুই কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এক. সিলিন্ডার মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে এবং দ্বিতীয়ত. বেলুনে গ্যাস ভরার সময় অসাবধনাবশত লিকেজ হলে।

হাইড্রোজেন গ্যাসে ফোলানো বেলুন ফেটে কাছের সামান্য সিগারেটের আগুনেই ঝলসে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর যে সিলিন্ডারের ভিতরে হাইড্রোজেন গ্যাস থাকে সেখান থেকে যদি গ্যাস নির্গত হয় তাহলে বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু হিলিয়াম গ্যাসে বিপদ ততটা থাকে না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হিলিয়াম গ্যাসের মূল্য হাইড্রোজেন গ্যাসের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। আবার হিলিয়াম সহজে পাওয়াও যায় না। এজন্য দেশে কম দামে কিছু মানুষ বিপজ্জনকভাবে বেলুনে গ্যাস ভরে তা বিক্রি করেন। এই বেলুনটি যখন তৈরি করা হয় তখন তার আশপাশে যখন শিশুরা থাকে তখন সেটি বেশি বিপজ্জনক। এজন্য দুর্ঘটনা রোধে এ ধরনের বেলুনের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। কারণ একটি শিশুর জীবনের মূল্য একটি বেলুনের চেয়ে বেশি। সরকার এ ধরনের বিপজ্জনক পদার্থের ব্যবহার কেন এখনো বন্ধ করতে পারছে না- তা বোধগম্য নয়। বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক সুলতানা ইয়াসমীন বলেন, যে সব কারখানায় এ ধরনের নিষিদ্ধ হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করা হয় সেগুলো পরিচিত বা চিহ্নিত কারখানা নয়। বেলুনে যে গ্যাস ভরার কথা তা না করে যদি গোপনে অন্য কেউ ঝুঁকিপূর্ণ কোনো পদার্থ ব্যবহার করে থাকে সেটি নিঃসন্দেহে বেআইনি। কিন্তু এর কোনো পরিচিত মজুদগার না থাকায় এবং এর লাইসেন্সিংয়ে কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় এর সঙ্গে জড়িতদের ধরা খুব মুশকিল। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসনের আলাদা তদারকি বা মোবাইল কোর্টের নজরদারি থাকার কথা। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যদি অভিযান পরিচালনা করা যায়, তাহলে হয়তো দুর্ঘটনার হার কমে আসবে। 

সর্বশেষ খবর