রবিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পাঁচ তরুণ লিবিয়ায় জিম্মি, ফেরার আকুতি

মাদারীপুর প্রতিনিধি

মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পাঁচখোলা গ্রামের পাঁচ তরুণ লিবিয়ার মাফিয়াদের কাছে ১৮ মাস ধরে বন্দি রয়েছেন। তারা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। মুক্তিপণের জন্য তাদের ওপর চালানো হচ্ছে নিষ্ঠুর নির্যাতন। নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে তাদের পরিবার থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে দালাল চক্র। বারবার নির্যাতন করায় তরুণদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিরাজ করছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা।

লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার পাঁচ তরুণ হলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পাঁচখোলা গ্রামের মান্নান ব্যাপারীর ছেলে সজীব ব্যাপারী (২৫), খালেক মৃধার ছেলে আরিফ মৃধা (২৮), ছিছু মৃধার ছেলে রনি মৃধা (১৮), কিনাই মৃধার ছেলে সজীব মৃধা (২০) ও রুহুল খানের ছেলে রুবেল খান (২২)। পরিবারের দাবি, তাদের লিবিয়ায় পাঠানো, মুক্তিপণসহ এ পর্যন্ত প্রতিটি পরিবার ২৫ লাখ করে টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সজীব মৃধা, আরিফ, রনি, সজীব বেপারী ও রুবেল খানকে ইতালি পাঠানোর জন্য শরীয়পুরের তুলাতলা গ্রামের কামরুজ্জামান খান টুলু ও তার ভাই রাসেদ খানের সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক প্রথম দফায় টুলু ও রাসেদ খানকে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছে এ পাঁচ পরিবার। এরপর গত বছরের মাঝামাঝি এ তরুণদের লিবিয়ায় পাচারের পর মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। পরে তাদের মুক্ত করার জন্য আরও প্রায় দেড় কোটি টাকা আদায় করেন টুলু ও রাসেদ; যা বিভিন্ন সময় টুলুর স্ত্রী হাসিনা বেগম ও রাসেদের স্ত্রী সোমা গ্রহণ করেন এবং কিছু টাকা অ্যাকাউন্ট নম্বরেও দেওয়া হয়। এর পরও তাদের মুক্ত না করে দফায় দফায় নির্যাতন চালায় মাফিয়ারা। নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে আরও টাকা দাবি করে। বন্দি আরিফ মৃধার মা শেফালী বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে লিবিয়ার মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে টুলু-রাসেদ। এরপর নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে কয়েক দফায় ২৫ লাখ টাকা নিয়েছে। আমাদের জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আমার কোনো সহায়সম্বল নেই। আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’ বন্দি রুবেলের ভাই আজিজুল হক খান বলেন, ‘আমার ভাইসহ এলাকার পাঁচজন লিবিয়ার মাফিয়াদের কাছে দেড় বছর ধরে বন্দি। তাদের ইতালি পাঠানোর কথা বলে দালাল টুলু-রাসেদ লিবিয়ার মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাদের ঠিকমতো খাবার দেয় না। ইতালিও পাঠায় না। দেশেও আসতে দেয় না। দফায় দফায় নির্যাতন চালিয়ে টাকা আদায় করছে।’ রনির ভাই জাকির হোসেন মৃধা বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে একটা ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করছে দালালরা। ভাইকে ছাড়াতে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২৫ লাখ টাকা চলে গেছে। আমার ভিটেমাটি সব বিক্রি করা শেষ। এখনো আমার ভাই ছাড়া পায়নি। আমার ভাইকে ওরা মারধর করে যা করেছে, ওকে দেখলে চেনা যায় না। দালালরা এত দিন ভয় দেখিয়েছে, যদি থানাপুলিশ করি, তাহলে ওরা রনিকে মেরে ফেলবে।’ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ওই পাঁচ তরুণসহ অন্তত ১২ জনকে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ওই পাঁচ তরুণের পরিবারের দাবি, ১৯ সেকেন্ডের ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি কক্ষে একজনের পিঠের ওপর আরেকজনকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তাদের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক যুবক। ওই যুবকের হাতে একটি মোটা লাঠি। ওই লাঠি দিয়ে সে তাদের পেটাচ্ছে। ভিডিওতে তরুণদের ব্যথায় কাতরাতে শোনা যায়। এদিকে সম্প্রতি র‌্যাব-৮ মাদারীপুরের একটি দল তানভীর নামে এক তরুণকে পাচারের মামলায় প্রধান আসামি টুলু খানকে গ্রেফতার করে সদর থানায় হস্তান্তর করে। টুলুকে গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও অনেকেই থানায় আসেন। এ সময় রনির ভাই জাকির হোসেন মৃধা সদর থানায় টুলু ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও মানব পাচারের অভিযোগ দেন। টুলুর স্ত্রী হাসিনা বেগমকে স্থানীয়রা আটক করে থানায় হস্তান্তর করে। তবে অভিযোগটি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হননি। হাসিনা বেগমকেও ছেড়ে দেন। ভুক্তভোগীদের দাবি, আর্থিক সুবিধা পেয়ে মামলা নেননি ওসি এবং অভিযুক্ত হাসিনা বেগমকে ছেড়ে দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জাকির হোসেন মৃধা বলেন, ‘আমি থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছিলাম।

শুনেছি সেটা মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘দালালের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে আমাদের মামলা নেননি ওসি এবং আসামি ছেড়ে দিয়েছেন।’ মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি এ এইচ এম সালাউদ্দিন বলেন, ‘পাঁচখোলা থেকে কিছু লোক থানায় আসে। তারা জানান তাদের ছেলেরা এই দালালের খপ্পরে পড়ে এখন লিবিয়ায় বন্দি।

 তারা থানায় মামলার জন্য এজাহার দিলেও এ মামলা এখানে করার সুযোগ নেই।’ মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ‘মানব পাচারের ঘটনায় অভিযোগ দিলে অবশ্যই মামলা হবে। মামলা না নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

সর্বশেষ খবর