শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বছরে সহস্রাধিক পরিচয়হীন লাশ

মাহবুব মমতাজী

বছরে সহস্রাধিক পরিচয়হীন লাশ

রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকা থেকে প্রায়ই অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই খুনের শিকার। হত্যার পর লাশ গুম করতে খুনিরা নদী ও জলাশয়ে ফেলে দেয়। কখনো আবার মহাসড়কের পাশে নির্জন স্থানে ফেলে রাখে।

অনেক ঘটনার মধ্যে ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে গলা কাটা অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেন শেরেবাংলা নগর থানার এসআই জনি। ১৭২৮ নম্বর সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে তৎক্ষণাৎ লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

একই বছরের ২৭ নভেম্বর গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে ঢাকা রেলওয়ে থানা পুলিশ। গাজীপুরের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিম লাশের ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়েও তা শনাক্ত করতে পারেনি। এ ঘটনায় জয়দেবপুর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলাও হয়েছে। মামলা নম্বর ২৪৫। ঘটনা দুটির সাড়ে তিন বছর পরও তাদের পরিচয় জানা যায়নি। পরে এসব অজ্ঞাত লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাতব্য সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়েছে।

পিবিআইর সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের তথ্যানুযায়ী, অজ্ঞাত লাশের ৭৭ দশমিক ৭৯ শতাংশের পরিচয় মেলেনি এখন পর্যন্ত।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর- এই পাঁচ বছরে ৬ হাজার ২১৩ জনকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করেছে তারা। অর্থাৎ প্রতি বছরে ১ হাজার জনের বেশি মানুষ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। আর ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত দাফন করেছে ১ হাজার ৪৫৩টি লাশ। এর বাইরে ২০২০ সালের নভেম্বরে ২২টি অজ্ঞাত হাত-পা দাফন করেছে তারা।

পিবিআইর প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, অজ্ঞাত যত লাশ পাওয়া যায়, এর মধ্যে সব হত্যাও না এবং দুর্ঘটনাও না। এর মধ্যে অবশ্যই খুনের কিছু ঘটনা ঘটে। আমরা এ পর্যন্ত দেড়শরও বেশি অজ্ঞাত লাশের তদন্ত করে খুনের ঘটনা উদঘাটন করেছি। তবে লাশ শনাক্ত না হলে পরবর্তী তদন্ত কঠিন হয়ে যায়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীর কোলঘেঁষা তুরাগ নদ, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, শীতলক্ষ্যা নদীসহ বিভিন্ন জলাশয়; এর বাইরে ডেমরা, মিরপুর বেড়িবাঁধ, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর রেললাইনের দুই পাশ, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের পাশ থেকে প্রায়ই অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। পচে গন্ধ বের না হলে এসব লাশ কারও নজরে আসে না। এসব লাশের মধ্যে কোনোটি গুলিবিদ্ধ, কোনোটিতে ধারালো অস্ত্রের চিহ্ন, কোনোটি বস্তাবন্দি, কোনোটির হাত-পা বাঁধা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শরীরে জখমের চিহ্ন থাকে। 

ঢাকা রেলওয়ে থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টলা ট্রেন থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সন্দেহ হলে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য লাশের নমুনা পাঠায় পুলিশ। ভিসেরা রিপোর্টে দেখা যায়- শ্বাসরোধে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এরপর ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করে। এর আগে এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। এই হত্যা মামলার রহস্য এখনো উদ্ঘাটন হয়নি।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে একটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে পুলিশ প্রাথমিক সুরতহাল করে আঞ্জুমান মুফিদুলের কাছে দিয়ে দেয় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের জন্য। ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত হাজারখানেক বেওয়ারিশ লাশের মতোই। কিন্তু ঘটনার মোড় নেয় যখন আঞ্জুমান মুফিদুলের কর্মীরা তাকে দাফনের আগে গোসলের জন্য নেন। মৃত ব্যক্তির কোমরে কিছু কাগজ খুঁজে পান তারা। তার কোমরে আইডি কার্ড আর ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড পাওয়া যায়। আইডি কার্ড দিয়ে শনাক্ত করা যায়নি। এরপর পুলিশকে জানালে তারা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে তার পরিচয় বের করে। এদিকে ২০১৯ সালের ২ আগস্ট ফাস্ট পার্সেল অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেল সহকারী এনামুল হক নিখোঁজ হন। এনামুল খুলনার চালনা উপজেলার রেজাউল করিম খানের ছেলে। ওই দিন সন্ধ্যার পরও বাসায় না ফেরায় সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে নিখোঁজের পরিবার শাহবাগ থানায় একটি জিডি করে। জিডি নম্বর-৩৪০। তবে এনামুলকে এখনো পাওয়া যায়নি বলে শাহবাগ থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়। পিবিআইর সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে গত বছরের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ৮১৯টি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে কাজ করেছে পিবিআই। এর মধ্যে পরিচয় শনাক্ত হয়েছে ৬২৬টি লাশের, যাদের মধ্যে পুরুষ ৪৫৯ ও নারী ১৬৭ জন। শনাক্তের হার ২২ দশমিক ২১ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর