মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চিকিৎসা ও শিক্ষার চাপ ঢাকার ওপর

♦ ১১৩ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫৫টি, বিশেষায়িত ও মানসম্মত ♦ সব হাসপাতাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকায়, জনঘনত্বের চাপে রাজধানী

হাসান ইমন

চিকিৎসা ও শিক্ষার চাপ ঢাকার ওপর

নামকরা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম স্কুল এবং সরকারি-বেসরকারি বিশেষায়িত সব হাসপাতাল ঢাকায়। দেশের অন্যান্য বিভাগ ও জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল থাকলেও মানসম্মত না হওয়ায় পড়তে এবং চিকিৎসা নিতে সবাই আসছে রাজধানীতে। অন্যান্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় ঢাকাই হয়ে উঠেছে মানুষের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির কেন্দ্রস্থল। ফলে প্রতিনিয়ত সারা দেশের মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। এতেই চাপ পড়ছে ঢাকার ওপর।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৬। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জনসংখ্যা ৫৯ লাখ ৯০ হাজার ৭২৩। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংখ্যা ৪৩ লাখ ৫ হাজার ৬৩। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, প্রকৃত জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে ১ কোটি ২০ লাখ। আর ঢাকা উত্তর সিটিতে লোকসংখ্যা ৫৫ লাখ। আর জনঘনত্বের হিসাবে ৬৩ শতাংশ এলাকায় প্রতি একরে ৩০০-এর বেশি মানুষ বসবাস করে। বিশাল এ জনসংখ্যার চাপে বেসামাল হয়ে পড়ছে এই রাজধানী। পাশাপাশি সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল সবকিছুই গড়ে উঠছে মহানগরকে কেন্দ্র করে। এসব কারণেই মানুষ ঢাকায় ছুটে আসছে।

শিক্ষার জন্য ঢাকামুখী মানুষ : সরকারের তথ্য বলছে, পরীক্ষার ফলাফলে গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও দেশের সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল জেলা স্কুলগুলো। বর্তমানে সেগুলোর নাজুক অবস্থা। দেশের নামকরা বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন ঢাকায়। সংখ্যায়ও বেশি। মফস্বলের স্কুল বা কলেজ যেখানে শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে, ঢাকায় তখন ভর্তি নিয়ে চলছে অভিভাবকদের যুদ্ধ। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস)-সহ বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, শুধু উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে এই শহরে বসবাস করছে ২০ লক্ষাধিক মানুষ। এ ছাড়া সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়াম বা নামকরা বড় স্কুলে পড়াতেও অনেক পরিবার হয়েছে ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। দেশের ১৪২টি নিবন্ধিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ৭৬টিরই অবস্থান ঢাকায়। ফলাফলের ভিত্তিতে দেশের শীর্ষ ১০ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলও এই শহরে। ৪৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি ও ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫টিই ঢাকায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে ও সন্তানকে পড়াতে ঢাকার বাসিন্দা হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। একই সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন নামকরা কলেজ, মেডিকেল কলেজ, আইন কলেজ, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষা নিতে ঢাকার বাইরে থেকে ছুটে আসছে শিক্ষার্থীরা। অসংখ্য কোচিং সেন্টারে চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতেও ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে লাখো তরুণ। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীও এখন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা।

উন্নত চিকিৎসায় ভরসা ঢাকা : হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অর্থোপেডিক, শিশুরোগ, ক্যান্সার, বক্ষব্যাধিসহ সব জটিল রোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠেছে ঢাকায়। এসব হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য সারা দেশ থেকে রোগীদের নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসছেন স্বজনরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি রোগী দেখা হয়, যার বড় অংশ আসছে ঢাকার বাইরে থেকে। অন্য জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতাল থেকেও রোগী পাঠানো হচ্ছে ঢাকায়। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৪টি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৩১টিই ঢাকা শহরে। এ ছাড়া ১৮টি সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের মধ্যে ১৪টিই ঢাকায়। রোগীর পাশাপাশি সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছে এসব মেডিকেল কলেজে। একই সঙ্গে পাঁচতারকা মানের সবগুলো বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে ঢাকায়। চিকিৎসাসেবা ও হাসপাতালকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের জন্য লাখ লাখ মানুষ ঢুকছে ঢাকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সবকিছুই রাজধানীকেন্দ্রিক। বিশেষ করে শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু শিক্ষার্থী জেলা পর্যায়ে পড়াশোনা করলেও মাধ্যমিকের পর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য প্রায় সবাই ঢাকা যেতে চায়। কারণ মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সবই ঢাকায়। এ ছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ের ক্ষেত্রে যেসব পরিবার উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত তাদের ইংলিশ মিডিয়াম ও মানসম্মত বাংলা মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছেলেমেয়েদের ভর্তি করান। অন্যদিকে উপজেলা, জেলা ও বিভাগকেন্দ্রিক মানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থা এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে না ওঠায় সবাই সেবা নিতে আসছেন ঢাকায়। আর নীতিনির্ধারকরা এলাকায় তাদের ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা করান না। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিও করান না। মানসম্মত চিকিৎসা ও শিক্ষার পরিবেশ না পাওয়ায় সবাই ঢাকায় আসছে। এতেই চাপ পড়ছে ঢাকার ওপর। জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। মূলত ঢাকায় মানুষ আসছে তিন কারণে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও আয়ের জন্য। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ এবং ভালো মানের ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম গড়ে উঠেছে। ব্যয়বহুল হলেও মানসম্মত হওয়ায় ছেলেমেয়েরা ভর্তি হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানে। যদিও আগে জেলার স্কুলগুলোর মান অনেক ভালো ছিল। একই অবস্থা চিকিৎসা ক্ষেত্রেও। মানসম্মত না হওয়ায় সবাই চিকিৎসাসেবা নিতে ঢাকায় আসছে। আর নীতিনির্ধারকরাও এলাকায় ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল গড়ে তুলতে তেমন আগ্রহী নন। এসব কারণে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আর এই উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। এর মধ্যে বিভাগ ও জেলাকেন্দ্রিক বিশেষায়িত স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে উপযুক্ত মানের চিকিৎসকও হাসপাতালগুলোতে পাঠাতে হবে। যাতে ওই বিভাগ বা জেলার মানুষ ঢাকায় সেবা নিতে না আসেন। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তা করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর