বৃহস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

করতোয়া গিলছে প্রভাবশালীরা

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

করতোয়া গিলছে প্রভাবশালীরা

বগুড়ায় করতোয়া নদী দখল করে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হওয়া করতোয়া নদীর দুই পাড় অবৈধভাবে দখল করে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বিভিন্ন ভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দখল করা নদীর জায়গায় অবৈধভাবে ভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে আয় করছে লাখ লাখ টাকা। সেই সঙ্গে ড্রেনের আবর্জনা ফেলে নদীটি ভরাটও করা হচ্ছে সমানতালে। এক সময়ের যৌবনভরা নদীটি এখন বড় নালায় পরিণত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ১৮০ কিলোমিটার করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচীন পু-্রনগরীর গোড়াপত্তন হলেও সেই সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়া নদীও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে।

নদীটি বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে জেলার শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় বাঙালি নদীতে গিয়ে মিলেছে। এর মধ্যে অধিকাংশ স্থানে নদী দূষণ, দখল, ভরাট, চাষের আওতায় নেওয়া, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, পানিপ্রবাহ না থাকায় এখন মৃত প্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে। উত্তরে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার দিকে করতোয়া নদীর প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে। একদিকে পানিশূন্যতায় প্রবাহ বন্ধ। অন্যদিকে ভরাট আর দখলের ফলে নদীটি এখন মৃত। শহরের ভিতরের যে যেখানে পেরেছে নদীর পাড় দখলে নিয়ে ভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে। শুষ্ক মৌসুমে দখল তৎপরতা বেশি হয়। করতোয়া নদীতে দুই একটি স্থানে পানি দেখা গেলেও শহর ও শহরতলির প্রায় ২৭ কিলোমিটারে শুধু ড্রেনের কালো পানি বয়ে যায়। অব্যাহত দখল, শহরের বাসা-বাড়ির বর্জ্য, খনন বা সংস্কার না হওয়া ও দূষণে পচা নর্দমার ড্রেনে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শহর এলাকার মধ্যে চেলোপাড়া, উত্তর চেলোপাড়া, মালতীনগর, ফুলবাড়ী, মাটিডালি, রাজাবাজার, ফতেহ আলী সেতু, মহাস্থানগড় এলাকায় দখলের হার সবেচেয়ে বেশি। এই এলাকাগুলোতে দখল অব্যাহত রয়েছে। করতোয়া নদীর তীরবর্তী ২৮টিরও বেশি স্পট দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ চললেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। একদিকে দীর্ঘদিন খনন না হওয়া ও অন্যদিকে দখল চলতে থাকায় বগুড়ার মানচিত্র থেকে প্রমত্তা করতোয়া নদী তার ঐহিত্য হারিয়ে যেতে বসেছে। শহরের ময়লা ও কলকারখানার বর্জ্য ফেলায় পানি দূষিত হওয়ায় নদীতে এখন আর মাছও পাওয়া যায় না।

বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকার নদীপাড়ের বাসিন্দা জিয়াউল হক জানান, করতোয়া নদী প্রতিনিয়ত দখল হচ্ছে। প্রশাসন থেকে অনেকবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও পরে আবারও অনেকেই সেই স্থানে ঘর তুলেছেন। দখল-দূষণ বন্ধ না করলে আর কিছুদিন পর ছোট খালে পরিণত হবে। নদীতে বর্ষা মৌসুম বা বন্যার সময় ছাড়া পানি দেখা যায় না। নদীর তলায় এখন ড্রেনের কালো পানি। নদী থেকে প্রতিদিন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মশা, মাছির উৎপত্তিসহ নানা রোগ জীবাণু ছড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল জানান, নদীতে দখল, দূষণ ও অবৈধ দখলের কারণে ২০১৫ সালে একটি মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়া পৌর মেয়র, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদফতরকে নদী রক্ষায় এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। এ ছাড়া গাইবান্ধার কাছে করতোয়া নদীতে যে অংশে বাঁধ দিয়ে প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে সেটি সরিয়ে দিয়ে নদীতে প্রবাহ সচল রাখতেও বলা হয়। কিন্তু এসব পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বগুড়ায় জেলা প্রশাসনের তৈরি করা দখলকারীদের তালিকাতে কয়েকজন প্রভাবশালীর নাম রয়েছে।

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হক জানান, করতোয়া নদী রক্ষায় বেশকিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। করতোয়া নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলছে। বর্তমানে এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে করতোয়া নদীর পরিবেশ দূষণ বন্ধ, শহরের যানজট নিরসনে সড়ক নির্মাণ। নদী দখলমুক্ত করণ। করতোয়া নদীর বগুড়া জেলা অংশের শিবগঞ্জ উপজেলার উত্তরের সীমানা থেকে শেরপুর উপজেলার দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত মোট ১২৩ কিলোমিটার এলাকা খনন। নদীর দুই পাড়ের ২৭ কিলোমিটার এলাকায় ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা ও ৬ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ, মাস্টার ড্রেন নির্মাণকাজ, পানি নিয়ন্ত্রণে তিনটি অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর দুই পাড়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ, পানির ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণকাজ। এ প্রকল্পের অধীনে ভূমি অধিগ্রহণ থাকবে। প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা আরও বেড়ে যেতে পারে। কারণ নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, করতোয়া নদী হচ্ছে বগুড়ার প্রাণ। কিন্তু দখল-দূষণে করতোয়া নদীর প্রাণবৈচিত্র্য প্রায় নিঃশেষ। শহরের অংশে প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার নদী প্রবাহিত হয়েছে। এই নদীকেন্দ্রিক শহর ছিল একসময় বগুড়া। সভ্যতার বিবর্তনে করতোয়া এখন ধুঁকছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করতোয়া নদীর দুই পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অনেকবার অভিযান চালানো হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়াও করতোয়া নদী খনন ও করতোয়ার পশ্চিম পাশ দিয়ে একটি রাস্তা নির্মাণ করে শহরের যানজট নিরসনে চেষ্টা চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সর্বশেষ খবর