শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

জালিয়াতির মহোৎসব শিক্ষক নিয়োগে

মাস্টারকার্ড কারসাজিতে আটক ৩৭, রংপুরে তিন শিক্ষকসহ আটক ৫৪

প্রতিদিন ডেস্ক

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির মহোৎসব ঘটেছে। এ ঘটনায় র‌্যাব ও পুলিশ সাত জেলায় শিক্ষকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটক করেছে। জব্দ করা হয়েছে শতাধিক মোবাইল, বেশকিছু ইলেকট্রনিক যন্ত্র ও ব্যাংক চেক।

পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র জানান, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের আটক করা হয়। সবচেয়ে বেশি আটক করা হয়েছে গাইবান্ধা থেকে। জালিয়াত চক্রের পাঁচ হোতা, ৩০ পরীক্ষার্থীসহ মোট ৩৭ জনকে আটক করা হয়েছে এ জেলা থেকে। এ ছাড়া রংপুর থেকে আটক হয়েছেন ১৯ জন, যার মধ্যে রয়েছেন তিন শিক্ষকও। লালমনিরহাটে ১৩ ও ঠাকুরগাঁও থেকে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। আরও তিন জেলায় কয়েকজনকে জালিয়াতির অভিযোগে আটকের খবর পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, আটক পরীক্ষার্থীরা হল থেকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে চক্রের সদস্যদের প্রশ্ন জানিয়ে প্রণ। অন্যদিকে অভিযুক্ত শিক্ষকরা দ্রুত এসব প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দেন চক্রটিকে। পরে চক্রের সদস্যরা প্রশ্নের উত্তরগুলো সেই ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের জানিয়ে দিতেন। এজন্য পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হতো মোটা অঙ্কের টাকা।

র‌্যাবসূত্র জানান, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অভিনব উপায়ে তৈরি মাস্টারকার্ডের মধ্যে ইলেকট্রনিক ডিভাইস সংযুক্ত করে জালিয়াতির সময় জালিয়াত চক্রের পাঁচ হোতা ও ৩০ পরীক্ষার্থীকে আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র?্যাব-১৩)। গতকাল গাইবান্ধা সদরের বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২২টি ইলেকট্রনিক ডিভাইস সংযুক্ত মাস্টারকার্ড, ১৯টি ব্লুটুথ ডিভাইস ও ১৬টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

আমাদের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধায় প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও মোবাইলের মাধ্যমে জালিয়াত চক্রের ৩৭ জনকে গ্রেফতার করেছে র?্যাব। এ সময় ২৪টি মাস্টারকার্ড, ২০টি ব্লুটুথ, ১৭টি মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ব্যাংকের চেক উদ্ধার করা হয়। সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত (পরীক্ষা চলাকালে) বিভিন্ন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

এ বিষয়ে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে র‌্যাব-১৩-এর অধিনায়ক আরাফাত ইসলাম এক প্রেস কনফারেন্সে জানান, ৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় র?্যাব-১৩ গাইবান্ধা ক্যাম্পের একটি আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে একটি জালিয়াত চক্র ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে অসদুপায় অবলম্বন করে গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রাইমারি সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। পরে সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বিভিন্ন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতা পাঁচজন ও ৩২ পরীক্ষার্থীকে তাদের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং মোবাইল ফোনসহ পরীক্ষার হলরুম থেকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার মারুফ, মুন্না, সোহেল, নজরুল ও সোহাগ বিভিন্ন পরীক্ষার্থীকে ১৪-১৮ লাখ টাকায় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে আসছিলেন। সোহেল ডিভাইস সংগ্রহ ও বিতরণ করেন, নজরুল পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতেন এবং মারুফ ও মুন্না বাইর থেকে প্রশ্নপত্র সমাধান করে পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ করেন।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, লালমনিরহাটে প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতির অভিযোগে ১০ নারীসহ ১৩ পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে পুলিশে সোপর্দ ও আরও তিন পরীক্ষার্থীকে অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টায় লালমনিরহাট সরকারি কলেজ, সরকারি মজিদা খাতুন কলেজ, লালমনিরহাট সরকারি বালক ও বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়, লালমনিরহাট আদর্শ ডিগ্রি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একযোগে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা চলাকালে এসব কেন্দ্র থেকে ১৬ পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে অপরাধ বিবেচনা করে ১৩ জনকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।

লালমনিরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার চৌধুরি বলেন, ‘এ জেলায় মোট ১৬ হাজার ৩২৪ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১২ হাজার ৪২৭ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে পরীক্ষা চলাকালে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতি করার কারণে ১৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু বহিষ্কৃত ১৬ জনের মধ্যে অপরাধ বিবেচনায় ১৩ জনকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। এ ১৩ জনকে আসামি করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস মামলা করবে। তিনি আরও বলেন, আটকদের মধ্যে ১০ নারী ও তিন পুরুষ রয়েছেন। পরীক্ষা কেন্দ্রের হল সুপার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের আটক করে পুলিশে দিয়েছেন।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে তিন প্রার্থীকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার করা হয়েছে ১১ প্রার্থীকে। এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নবেজ উদ্দীন সরকার জানান, পরীক্ষা ঘিরে জেলায় তৎপর হয়ে ওঠে কিছু কুচক্রী। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে এবং চুক্তিভিত্তিক পরীক্ষা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ (হল কন্ট্রাক্ট) নিয়ে অসদুপায় অবলম্বনের আশঙ্কা করেন অনেক চাকরিপ্রত্যাশী। তবে জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে স্বচ্ছভাবে এ পরীক্ষা নেওয়ার আয়োজন করে। কিন্তু জেলার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে গতকাল অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে তিন প্রার্থীকে বহিষ্কার ও আরও ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, নীলফামারীর সৈয়দপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও মোবাইলের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে পরীক্ষা দেওয়ার সময় তিন পরীক্ষার্থীকে আটক করেছেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। সকালে পরীক্ষা চলাকালে সৈয়দপুর শহরের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাদের আটক করা হয়।

সৈয়দপুর থানা পুলিশ জানায়, সৈয়দপুর সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, কয়া গোলাহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং সৈয়দপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ কেন্দ্রে তিন পরীক্ষার্থী ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও মোবাইল ব্যবহার করে পরীক্ষা দিতে থাকেন। প্রযুক্তি ব্যবহার করে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা তাদের আটক করে কেন্দ্রসচিবকে অবগত করেন। কেন্দ্রসচিব তাদের কেন্দ্রে কর্তব্যরত পুলিশে তুলে দেন। হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় হবিগঞ্জে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের অভিযোগে এক পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. গোলাম মাওলা বলেন, প্রথম ধাপের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অভিনব উপায়ে তৈরি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের কারণে এক নারী পরীক্ষার্থীকে শহরের টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে বহিষ্কার করা হয়। যদিও তিনি ওই শিক্ষার্থীর পরিচয় জানাননি।

সর্বশেষ খবর