সোমবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজনীতির ধাক্কায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি

স্থিতিশীলতা না এলে আরও গভীর সংকটের শঙ্কা। দ্রুত কমছে রিজার্ভ। নিয়ন্ত্রণে আসছে না পণ্যমূল্য। বাজেট বাস্তবায়নের হার ১১ বছরে সর্বনিম্ন

মানিক মুনতাসির

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে। যার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের আর্থিক খাত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে টানা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকগুলো রয়েছে নেতিবাচক ধারায়। নানা ধরনের নিয়ন্ত্রারোপ করেও কমানো যাচ্ছে না আমদানি ব্যয়। সরকারের আর্থিক সংকট মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ছাপিয়ে সরকারকে টাকা সরবরাহ করেছে। অন্যদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রায় প্রতিদিনই। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাজেট বাস্তবায়নের হার নেমেছে ১১ বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রার বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভায় অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে অর্থবিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা না এলে আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে দেশের আর্থিক খাত। একই দিনে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় আগামী বাজেটেও বাজেট ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২০২৪) বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। আর মূল্যস্ফীতির বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সভায়    আগামী বাজেটের আকার নিয়েও আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। আসছে বাজেটের আকার হতে পারে ৮ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা।

অর্থবিভাগের একটি সূত্র জানায়, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমিয়ে ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৭ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যেখানে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা, তা কমিয়ে এখন ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। চলতি ২০২৩-২৪ বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। সূত্র জানায়, অর্থবিভাগের পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই ১২ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ সময়ে এনবিআরের পক্ষ থেকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া রপ্তানি আয় কমে যাওয়া, প্রবাসী আয় বাড়াতে না পারা, দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা ডলার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে সংকট বিরাজ করছে বলেও বৈঠকে জানানো হয়। এ জন্য আসছে অর্থবছর অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে করণীয় নির্ধারণেও নির্দেশনাও দেওয়া হয় বৈঠকে। ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রার সরবরাহ কমানো হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকার নতুন গাড়ি কেনা, ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়নীতি গ্রহণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

চলতি অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয় গত জুনে। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো বেশ চাপে থাকায় সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁট করা হয়েছে। এ জন্য অর্থবিভাগ ৭ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট প্রস্তাব করেছে। সভায় তা অনুমোদিত হয়। এর ফলে এবার মূল বাজেটের তুলনায় সংশোধিত বাজেটের আকার কমল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছর এ হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। সূত্র আরও জানায়, বৈঠকের নির্দেশনা অনুযায়ী এরই মধ্যে বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য টিসিবি এবং ওএমএস কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। বাজার মনিটরিংও বাড়ানো হচ্ছে। এসব কার্যক্রম অব্যাহত রেখে চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায় সরকার। যদিও মূল বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান  বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পৃথকভাবে পরিকল্পনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে অন্তত এই একটি বিষয়ে একমত পোষণ করা। অর্থনীতিকে রাজনীতিকীরকণের ফলাফল কখনই সুখকর হয় না বলে মনে করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর