বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
দূষিত কালো পানি পড়ছে নদীতে

তামাক বিষে বিপর্যস্ত হালদা

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

তামাক বিষে বিপর্যস্ত হালদা

এভাবে হালদা নদীতে পড়ছে বিষাক্ত পানি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীর উৎস এলাকা মানিকছড়ি। নদীর এ উজান অংশের বিভিন্ন এলাকায় হচ্ছে তামাক চাষ। তামাকের বর্জ্য ও কীটনাশকের পানি সরাসরি পড়ছে হালদায়। ফলে বিপজ্জনক প্রভাব পড়ছে হালদায়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হালদার মৎস্য প্রজনন। কমছে জমির উর্বরতা ও সবজি চাষ। নষ্ট হচ্ছে পানির ধারণক্ষমতা, ক্ষয় হচ্ছে মাটি। রাসায়নিকের প্রভাবে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য, পানি, জলজপ্রাণী ও পরিবেশ। তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে কোম্পানির লোভনীয় অফার। একই সঙ্গে হালদার শাখা খালের মাধ্যমে দূষিত কালো পানি পড়ছে নদীতে। অভিযোগ আছে, কিছু টোব্যাকো কোম্পানি অর্থের প্রলোভন এবং স্থানীয় মহাজনদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃষককে তামাক চাষে প্রলুব্ধ করছে। অসহায় আদিবাসী ও বাঙালি কৃষকের মাঝে ঋণের সহজলভ্যতা, সার, বীজ, কীটনাশক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ও নিজেদের বাজার ব্যবস্থাপনা করে দিচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে নগদ ১০ হাজার টাকা, যা পাতা সংগ্রহকালীন কেটে নেবে টোব্যাকো কোম্পানি। জানা গেছে, ২০১৬ সালে ‘হালদা নদীর উৎপাদনশীতা বৃদ্ধি ও হালদা উৎসের পোনার বাজার সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। সরকারি উন্নয়ন সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়ন ও ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) উদ্যোগ এবং মানিকছড়ি উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় উজান এলাকার জমিগুলোয় সবজি চাষ করা হয়। ২০২০ সালের দিকে হালদার উজান মানিকছড়ি অংশে তামাকের চাষাবাদ শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। কিন্তু ২০২১ সালে সেখানে ফের শুরু হয় তামাক চাষ। গত বছর থেকে মানিকছড়ির বড় একটি অংশের চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে টোব্যাকো কোম্পানি। এ অবস্থায় মানিকছড়ির ঘোরখানা, আসাদতলী, কালাপানি, তুলাবিল, ছদুরখীলের প্রায় ৩৫ হেক্টর জমিতে দেড় শতাধিক কৃষক নতুনভাবে তামাক চাষে জড়িয়ে পড়েছেন।

প্রসঙ্গত, তামাক চাষের উচ্ছিষ্ট পচা পাতা, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ধোয়া পানি বৃষ্টির সঙ্গে নদীতে গিয়ে পড়ে। একই সঙ্গে তামাক গাছের মূলও নদীতে এসে পড়ে। তা ছাড়া তীরে চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়ানোর কারণে পাতার উচ্ছিষ্ট অংশও নদীতে গিয়ে পড়ে। ডিম ছাড়ার সময় তামাকের বিষ ছড়িয়ে পড়ে নদীতে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিন হালদার শাখা খাল কাটাকালিতে গিয়ে দেখা গেছে, এ খাল দিয়ে কুচকুচে কালো পানি সরাসরি গিয়ে পড়ছে হালদায়। তা ছাড়া পানির সঙ্গে আছে বাণিজ্যিক, গৃহস্থালি, পোলট্রিসহ নানা ধরনের বিষাক্ত বর্জ্য। এসব বর্জ্য দূষণ করছে হালদার পানি। খন্দকিয়া খাল, কৃষ্ণকালি খাল ও কাটাকালি খাল দিয়ে প্রবেশ করে দূষিত পানি। হালদা পারের বাসিন্দা ও প্রবীণ ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর বলেন, তামাক চাষ ও দূষিত বর্জ্যরে কারণে হালদা নিয়মিত দূষণ হচ্ছে। যে কোনো মূল্যে দূষণ কমাতে হবে। না হলে মাছের প্রজননে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ২০১৭ সালে মানিকছড়িতে তামাক চাষ বন্ধে কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালে প্রায় ৯৯ শতাংশ তামাক চাষিকে মূলধারার কৃষিকাজে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ২০২২ সালে আবারও মানিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকহারে তামাক চাষ শুরু হয়। এটি বড় ধাক্কা। কারণ তামাকের নিজস্ব বিষাক্ততা আছে। চাষে বেশি পরিমাণ ইনসেকটিসাইট, পেস্টিসাইট ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়, যা পানিতে মিশে দূষণ ঘটায়। তামাকের এ বিষাক্ততা নিয়ে পাহাড়ি ঢল এলে সেই পানিতে মাছ ডিম ছাড়তে পারে না। তিনি বলেন, ‘হালদায় এখন দখল কম, দূষণ বেশি। দূষণের কারণে এশিয়ান পেপার মিল ও ১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। অনন্যা আবাসিক এলাকার দূষণও বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তামাকের বিষ, পোলট্রি বর্জ্য ও শাখা খালের দূষিত পানির কারণে দূষণ হচ্ছে। তবে হালদা নিয়ে একটি নতুন প্রকল্প অনুমোদন হয়েছ। আশা করি এ প্রকল্প নদীর সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করবে।’ চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘হালদায় কিছু দূষণ হওয়ার খবর আমরা পাচ্ছি। এরই মধ্যে দূষণের চিত্রগুলো উপজেলা মৎস্য অফিসের মাধ্যমে সংগ্রহ করছি। কারণ হালদা নিয়ে একটি প্রকল্প আসছে, প্রকল্প পরিচালকও নিয়োগ হয়েছে। এখন প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি দূষণসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করা যাবে। আশা করি বিদ্যমান সমস্যা নিরসন হবে।’

তামাকের ক্ষত দেহে : মানিকছড়ি উপজেলার আসাদতলী এলাকার ইরফান। গত বছর তিনি তামাক চাষ শুরু করেন। কিন্তু চাষ করার কিছুদিনের মধ্যেই তার পায়ে ক্ষত দেখা দেয়। দেখতে দেখতে পায়ের ক্ষত বেড়ে যায়। পুরো দুটি পা-ই দগদগে হয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এভাবে কেবল কামাল উদ্দিন নন, তামাক চাষে জড়িত অনেকের শরীরেই নানাভাবে ক্ষত তৈরি হয়। কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও শরীরের অন্য অংশে। তা ছাড়া তামাক চাষের কারণে চাষিদের মধ্যে বাড়ছে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, শ্বাসকষ্ট, পেট ব্যথা, বমিসহ নানা সমস্যা।

পুড়ছে কাঠ : ১ একর জমির তামাকের পাতা চুল্লিতে শুকাতে ৭২ ঘণ্টায় প্রয়োজন হয় ৬ টন কাঠ। এসব কাঠ আশপাশের বন থেকেই সংগ্রহ করা হয়। ফলে পুড়ছে কাঠ, উজাড় হচ্ছে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। ঘোরখানা, আসাদতলী, কালাপানি, তুলাবিল, ছদুরখীলে ৩৫ হেক্টর জমিতে করা তামাকপাতাগুলো বনের কাঠ দিয়ে পোড়া হচ্ছে। এভাবে কাঠ পুড়তে থাকলে আগামীতে বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।

সর্বশেষ খবর