শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নীতিগত জটিলতায় বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ভাটা

প্রণোদনার বদলে ব্যাংকে ঢুকলেই কাটছে কর, বাড়ছে হুন্ডি, তীব্র হচ্ছে ডলার সংকট

শামীম আহমেদ

নানা উদ্যোগের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেই চলেছে। বাড়ছে ডলারের দাম। এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক ব্যাংক। কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় ক্ষতির মুখে অনেক শিল্প। নানা প্রণোদনা ঘোষণার পরও বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসায় সাড়া মিলছে না। অথচ, শুধু আমলাতান্ত্রিক ও নীতিগত জটিলতার কারণেই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হাতছাড়া হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার হয়ে অনলাইনে বাংলাদেশে কাজ করেন সালামত হোসেন (ছদ্মনাম)। বাংলাদেশে কোনো অফিস না থাকায় নিউইয়র্কের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে স্থানীয় একটি ব্যাংকে বেতন পান তিনি। প্রতি মাসে প্রায় ১৮০০ ডলার তার অ্যাকাউন্টে ঢোকামাত্র ১০ শতাংশ কর (উৎস) কেটে রাখে ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে রুহুল আমিনের সহকর্মীরা বিদেশে পরিচিত কারও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বেতন নিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। কানাডার একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে বাংলাদেশে কর্মরত রবিনও একই চেষ্টা করছেন।

সালামত হোসেন বলেন, আমার মতো হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশে বসে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছেন। এটাও এক ধরনের রেমিট্যান্স। ফ্রিল্যান্সিংও বলা যায়। বিদেশ থেকে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠালে বা ফ্রিল্যান্সাররা অর্থ আনলে আয়কর দিতে হয় না। উল্টো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ ও ফ্রিল্যান্সিং আয়ে ৪ শতাংশ প্রণোদনা পায়। অথচ আমাদের বেতন ব্যাংকে ঢুকতেই টাকা কেটে নিচ্ছে, যেখানে আমার প্রতিষ্ঠান এখানে কোনো পণ্য বিক্রি করে আয় করছে না। তাছাড়া প্রতিমাসে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আমার চুক্তিপত্র এবং একটি চিঠি দিতে হয়। অন্যথায় ডলার টাকায় কনভার্ট হয়ে অ্যাকাউন্টে ঢোকে না। এসব ঝামেলার কারণে অনেকেই উপার্জনের অর্থ হুন্ডি করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশেই থেকে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, কেউ বিদেশে অবস্থান করে অর্থ রোজগার করলে তিনি প্রবাসী হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে থেকে কেউ বিদেশে সেবা দিলে তাকে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাজ বাংলাদেশে, তাদের কর্মীর আয় মজুরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই আয় করমুক্ত নয়। প্রণোদনার আওতায়ও নয়। এদের কেউ যদি ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ না এনে হুন্ডি করে, তাহলে তো তার টাকাটা অবৈধ হয়ে গেল। রাষ্ট্রের একজন সুনাগরিক এমন কাজ করবেন কেন? এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ‘এক নজরে আয়কর’ এর আর্টিকেল ১৭ (২)(ট) ধারায় বলা আছে, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেওয়া সেবা  থেকে উপার্জিত আয় ও দেশজুড়ে টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন  নেটওয়ার্ক ব্যবসা ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত আয়করমুক্ত থাকবে। ফলে, ফ্রিল্যান্সারদের আয়কর দিতে হবে না। একই আর্টিকেলের (থ) ধারায় বলা আছে, একজন বাংলাদেশি নাগরিক কর্তৃক বিদেশে উপার্জিত যে কোনো আয় এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে আনা এ ধরনের আয় করমুক্ত থাকবে। বিষয়টি নিয়ে একাধিক ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, রেমিট্যান্সের প্রণোদনা দেওয়া হয় যদি বিদেশ থেকে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক টাকা পাঠায়। বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি অর্থ পাঠালে তা রেমিট্যান্স হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। অন্যদিকে সরকারের দেওয়া ফ্রিল্যান্সার আইডি থাকলেই তাকে শুধু ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গণ্য করা হয়। এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, তার শ্যালকই কানাডার একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করেন। তার বেতন ঢুকলেই ১০ শতাংশ কর কাটা হয়। এ কারণে  সে বিদেশে অ্যাকাউন্ট তৈরির চেষ্টা করছে। তা করতে পারলে এই অর্থগুলোও আর দেশে আসবে না। এদিকে ব্যাংকিং জটিলতায় ফ্রিল্যান্সাররাও তাদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ দেশে আনছেন না বলে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এমনকি সরকারঘোষিত ৪ শতাংশ প্রণোদনাও কেউ পেয়েছেন বলে জানা যায়নি। জটিলতা রয়েছে ফ্রিল্যান্সার আইডি পাওয়া নিয়েও। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ডা. তানজিবা রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ফ্রিল্যান্সিং খাতে কিছু সমস্যা আছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের ইনসেনটিভ ফর্ম পূরণ করতে গেলে সেখানে কত কেজি পণ্য রপ্তানি করেছি সেই ঘর পূরণ করতে বলা আছে। আইটি পণ্য কীভাবে ওজন করা সম্ভব? এ ছাড়া আইটিতে কাজ করতে অনেক সফটওয়্যার অনলাইন থেকে কিনতে হয়। বাংলাদেশি কার্ড দিয়ে ডলারে পেমেন্ট করতে গেলে ঝামেলা হয়। তাই আমার আয়ের ৩০ শতাংশ দেশে আনি, বাকিটা বিদেশে রাখি। এগুলো সমাধান করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছি। ফ্রিল্যান্সার আইডি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে ফ্রিল্যান্সার রয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ। এর মধ্যে আইডির জন্য আবেদন করেছেন দেড় লাখের মতো। আইডি পেয়েছেন ৪৯ হাজার। তবে প্রণোদনার টাকা এখনো কেউ পেয়েছে বলে জানা নেই। অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয়। কীভাবে সঠিক ফ্রিল্যান্সার শনাক্ত করবে এটাও একটা সমস্যা। গড়পড়তায় প্রণোদনা দিলে অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইডি পেতে আবেদন করবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এখন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে এক্সপোনেট নামের একটি আইটি কোম্পানির স্বত্ব¡াধিকারী আবুল কাশেম বলেন, ব্যাংকের দেখার দায়িত্ব অর্থটা কোন উৎস্য থেকে আসছে। ফাইবার, আপওয়ার্ক- এসব মার্কেটপ্লেস থেকে অর্থ আসলে এটাকে ভুয়া বলার সুযোগ নেই। এখানে ফ্রিল্যান্সার আইডির প্রয়োজন হওয়ারই কথা নয়। আমার প্রয়োজন  বৈদেশিক মুদ্রা। উৎস্যটা বৈধ হলেই এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক।

সর্বশেষ খবর