শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

১৫০ অজ্ঞাত লাশে খুনের রহস্য

মাহবুব মমতাজী

১৫০ অজ্ঞাত লাশে খুনের রহস্য

খুনের পর উদ্ধার হওয়া অন্তত ১৫০টি কঙ্কাল বা অজ্ঞাত লাশের খুনের রহস্য তদন্ত করে খুঁজে বের করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের সিংহ নদী থেকে গত ২১ মে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত ব্যক্তির কঙ্কালের পরিচয় শনাক্ত করে হত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং খুনের রহস্য উদঘাটন করার সাফল্য দেখিয়েছে পিবিআই। এক্ষেত্রে কঙ্কালে জড়ানো কাপড় অনুসন্ধানের সূত্র হিসেবে কাজে লাগে। যা দেখে নিখোঁজের স্বজনরা তার পরিচয় নিশ্চিত করেন। তারা জানান, কঙ্কালটি রুমান শিকদারের (৩৯)। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ থানায় একটি মামলা করেন এস আই মাইদুল ইসলাম। আর এ ঘটনা তদন্ত করে পিবিআই জানতে পারে, পরকীয়ার ঘটনা স্থানীয়দের কাছে ফাঁস করে দেওয়ায় পরকীয়া প্রেমিকা আঁখির পরিকল্পনায় রুমান শিকদারকে হত্যা করে শুকনো সিংহ নদীতে লাশটি মাটিচাপা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নদীতে খনন কাজ করার সময় কঙ্কাল পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, অজ্ঞাত যত লাশ পাওয়া যায়, এর মধ্যে সব হত্যাও নয় এবং দুর্ঘটনাও নয়। এর মধ্যে অবশ্যই খুনের কিছু ঘটনা ঘটে। আমরা এ পর্যন্ত ১৫০-এর বেশি অজ্ঞাত লাশের তদন্ত করে খুনের ঘটনা উদঘাটন করেছি। তবে লাশ শনাক্ত না হলে পরবর্তী তদন্ত কঠিন হয়ে যায়। 

পিবিআইর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৫ হাজার ৮৯৩টি খুনের মামলার তদন্তের দায়ভার পেয়েছে তারা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪ হাজার ৯৪৯টি এবং তদন্তাধীন আছে ১ হাজার ৩৬৪টি খুনের মামলা। ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার আশুলিয়ায় অজ্ঞাত এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। তারও প্রায় এক বছর পর ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তদন্তে শনাক্ত হয় ওই নারীর পরিচয়। নাম শিল্পী আক্তার (৩০)। ছিলেন গার্মেন্টকর্মী। এ জন্য পিবিআইর পরিদর্শক সুরুজ উদ্দিন এক বছর সাত মাস ধরে মামলাটি তদন্ত করেন। এরপর প্রযুক্তির মাধ্যমে শিল্পী হত্যার প্রধান আসামি মামুনকে (২৮) ও তার সহযোগী রনি এবং রাসেলকে গ্রেফতার করা হয়। বেরিয়ে আসে খুনের রহস্য। পূর্বপরিচিত মামুন খারাপ কাজের প্রস্তাব দিয়েছিল শিল্পীকে। এরপর মামুনের কথামতো রনি ও রাসেল মিলে সাভার ইপিজেড থেকে শিল্পীকে নিয়ে এনায়েতপুর ফুলের টেকে নিয়ে যায়। সেখানে মেয়েটির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে মামুন। এরপর রনি শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইলে বাধা দেয় মামুন এবং মেয়েটিকে মেরে ফেলার কথা বলে। তিনজনে মিলে মেয়েটির গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মেরে ফেলে। এরপর ব্লেড দিয়ে মেয়েটির গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। মূলত বাবুল নামে একজনকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য মামুন ওই নারীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার পর যে যার মতো চলে যায়। দীর্ঘ দেড় বছর পর মামুনকে গ্রেফতার করার পর মামলাটির রহস্য উদঘাটন হয়। একইভাবে ২০২০ সালের ২৮ মে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে শিমুলতলায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ডিভাইডার থেকে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ পায় পুলিশ। তার বয়স ছিল আনুমানিক ২০। প্রাথমিকভাবে প্রত্যক্ষদর্শীরা ধারণা করেন- হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে মেয়েটি। লাশের ময়নাতদন্তের জন্য ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্রায় দুই মাস পর একই বছরের ২৩ জুলাই মামলাটির তদন্তের দায়ভার পায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পিবিআই। তদন্তে জানা যায়, মেয়েটির নাম পাপিয়া বেগম। তিনিও ছিলেন গার্মেন্টকর্মী। আরিফুল নামে এক ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পাপিয়াকে স্ত্রী পরিচয়ে একটি বাসা ভাড়া করে দেয়। পাপিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ের কথা ছিল। কিন্তু পাপিয়ার ভাই সাইফুল ইসলাম শাম্মি (তৃতীয় লিঙ্গ) এ সম্পর্ক মেনে নিতে চাননি। শাম্মি চাইত আরিফুল তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করুক। তারই জেরে ঘটে হত্যাকান্ড।

 ২০২০ সালের ২৭ মে পাপিয়ার ভাড়া বাসায় যায় আরিফুল। কিছুক্ষণ পর শাম্মিও ওই বাসায় যায়। এ সময় আরিফুলকে মারধর করে শাম্মি। আরিফুল ঘর থেকে বের হয়ে দোতলায় তার পরিচিত সামিয়ার বাসায় যায়। এসময় শাম্মির সঙ্গে পাপিয়ার তুমুল ঝগড়া বিবাদ হয়। কিছুক্ষণ পর আরিফুল ফের পাপিয়ার বাসায় গেলে সেখানে তাকে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় মৃত দেখতে পায়। এ সময় শাম্মি বলে, পাপিয়া গলায় ফাঁস নিয়ে মারা গেছে। শাম্মির ফোন পেয়ে তার বাবা জয়নাল মিয়া ও ভাই মামুন ঘটনাস্থলে আসে। তারা বুঝতে পারে শাম্মি নিজেই হিংসা ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে পাপিয়াকে হত্যা করেছে। তারা থানা পুলিশের ঝামেলা এড়ানোর জন্য পাপিয়ার লাশ ভৈরব ব্রিজ থেকে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। পিবিআই বলছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ১৪ হাজার টাকায় একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে। এরপর আরিফুল, জয়নাল, শাম্মি এবং মামুন রওনা দেয়। পথে পুলিশের চেকপোস্ট বারবার বাধা পড়ায় তারা ঘটনাস্থলে লাশ ফেলে চলে যায়। গ্রেফতার পাপিয়ার বাবা জয়নাল মিয়া ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে এসব জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর