সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

গৃহকর্মের কাজে নয় মনোযোগ চুরিতে

আলী আজম

মোছা. বিলকিছ বেগম ওরফে কনা ওরফে নূরজাহান। বয়স ২৫ বছর। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানার হাজংপাড়ায়। নূরজাহান ঢাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। কিন্তু গৃহকর্মের কাজে নয়, তার মনোযোগ থাকে চুরিতে।

একেকটি বাসায় নিজেকে একেক নামে পরিচয় দেন। একটি বাসায় কাজ নেওয়ার পর দ্রুত সে বাসার আদ্যেপান্ত জেনে নেন চতুর গৃহকর্মী নূরজাহান। কিছুদিন পর সুযোগ বুঝে গোপনে বাসার লোকজনদের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেন। বাসার লোকজন ঘুমের ওষুধ মেশানো খাবার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে কেটে পড়েন। এরপর চুরি করা জিনিসপত্র দ্রুত বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে লাপাত্তা হয়ে যান। ধুরন্ধর এই নূরজাহানের শেষ রক্ষা হয়নি। চলতি বছরের ২ আগস্ট পুরান ঢাকার কোতোয়ালি এলাকা থেকে নূরজাহানকে গ্রেফতার করেন পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) সদস্যরা।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নূরজাহানের স্বামীর নাম মো. ইসমাইল শেখ। তার বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ থানার রুকনাই গ্রামে। ২০১৯ সাল থেকে নূরজাহান ঢাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাতিরঝিল থানার দিলু রোডের একটি বাসায় মাসিক ৬ হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মীর কাজ নেন নূরজাহান। ওই বাসার লোকজনকে জানান, অভাবের তাড়নায় তিনি গ্রাম থেকে কাজের জন্য ঢাকায় এসেছেন। বাসার দারোয়ানের মাধ্যমে নূরজাহান কাজে যোগ দেন। বাসার লোকজন তার জাতীয় পরিচয়পত্র চাইলে তিনি কয়েকদিন পর দেবেন বলে জানান। তার ভাই গ্রাম থেকে দু-তিন দিনের মধ্যে আসবে। এলেই জাতীয় পরিচয়পত্র দেবেন বলে বাসার লোকজনকে জানান। কিন্তু কাজ নেওয়ার মাত্র ৪ দিনের মাথায় ওই বাসায় চুরি করেন নূরজাহান। ঘটনার দিন ১১ সেপ্টেম্বর সকালে গৃহকর্তা মনোয়ার আলী স্ত্রী ও কাজের মেয়ে নূরজাহানকে বাসায় রেখে অফিসের কাজে যান। অফিসে যাওয়ার পর মনোয়ার আলীর মেয়ে আমেরিকা থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় তাকে ফোন দিয়ে বলেন, তার মা ফোন রিসিভ করছেন না। মনোয়ার দ্রুত বাসায় চলে যান। গিয়ে দেখতে পান তার স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে বাসার খাটের ওপর শুয়ে আছেন এবং বাসার মালামাল এলোমেলো। বাসার কাজের মেয়ে নূরজাহান বাসায় নেই।

মনোয়ার দ্রুত তার স্ত্রীকে নিয়ে মগবাজার ইনসাফ আল বারাকা হাসপাতালে ভর্তি করান। পরে বাসায় গিয়ে জানতে পারেন, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা সোয়া ১১টার মধ্যে তার বাসায় চুরি হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তার স্ত্রীকে বাসায় একা পেয়ে কাজের মেয়ে নূরজাহান কৌশলে অজ্ঞান করে বাসার মূল্যবান জিনিসপত্র এলোমেলো করেন। বাসা থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং স্বর্ণের বালা ও স্বর্ণের চামচ, যার আনুমানিক মূল্য ১ লাখ ১২ হাজার টাকা চুরি করে নিয়ে যান।

পরে স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠলে ১২ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিল থানায় নূরজাহানসহ অজ্ঞাত আরেকজনকে আসামিকে করে একটি মামলা করেন গৃহকর্তা মনোয়ার আলী। মামলার তদন্ত শুরু করেন হাতিরঝিল থানার এসআই মো. রহমত উল্লাহ রনী। তিনি প্রায় চার মাস তদন্ত করেন। চুরির ঘটনাটি সত্য হলেও নূরজাহান এবং অজ্ঞাত আরেকজনের তথ্য সংগ্রহ এবং গ্রেফতার করতে পারেননি। চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি তিনি আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেন। পরে বাদীপক্ষ নারাজি দিলে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। ২৫ মে থেকে মামলাটি তদন্ত শুরু করেন পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) এসআই মো. রবিউল ইসলাম। ২ আগস্ট পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানার মুসলিম স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে থেকে নূরজাহানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পরে মনোয়ার আলীর বাসায় চুরির কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন নূলজাহান।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) এসআই মো. রবিউল ইসলাম বলেন, মনোয়ার আলীর বাসায় চুরি করা মালামালের বিষয়ে নূরজাহান একেক সময় একেক তথ্য দেন। তার তথ্যের ভিত্তিতে একাধিক স্থানে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু নূরজাহান মিথ্যা তথ্য দেওয়ার এসব অভিযানে সফলতা আসেনি। তদন্তে আসামির তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, হাতিরঝিলের ওই বাসায় চুরি ছাড়াও নূরজাহার আরও চারটি বাসায় চুরি করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

এর মধ্যে ২০১৯ সালের মে মাসে শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায়, ২০২০ সালের নভেম্বরে ভাটারা থানা এলাকায়, ২০২১ সালের এপ্রিলে খিলক্ষেত থানা এলাকায় এবং ২০২৩ সালের এপ্রিলে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় চুরি করেন নূরজাহান। নূরজাহান খুব ধুরন্ধর প্রকৃতির হওয়ায় তিনি একের পর এক বিভিন্ন বাসায় কাজের নামে চুরি করেছেন। নূরজাহান চোরাই টাকা-পয়সা ও অন্যান্য মালামাল বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেন এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করেন।

সর্বশেষ খবর