বুধবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
আনোয়ারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সন্ধ্যা নামলেই ভূতুড়ে বাড়ি

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

সন্ধ্যা নামলেই ভূতুড়ে বাড়ি

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাউন্ডারির ভিতরে অন্তত সাতটি ভবন আছে। এসব ভবন ও হাসপাতাল এলাকাকে আলোকিত করতে আছে বিদ্যুতের প্রায় ১৫-২০টি পোল। কিন্তু কোনোটিতেই বাতি নেই। ফলে সন্ধ্যা নামলেই পুরো হাসপাতাল এলাকা পরিণত হয় ভূতের বাড়িতে। অন্ধকারে চলে বখাটেদের আড্ডা, গাঁজা সেবনসহ নানা অপকর্ম। কিছুদিন আগে কয়েকজন বখাটেকে ধরে পুলিশেও দেওয়া হয়। রাতের অন্ধকারে ঝুঁকি নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয় নিরাপত্তা প্রহরীকে। রোগীদের অন্তহীন অভিযোগ। যেমন সময়মতো চিকিৎসক না পাওয়া, দেরিতে আসা, নার্স-আয়াদের দুর্ব্যবহার, টাকা দিয়ে সেবা নেওয়া ও রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা না থাকা, বিদ্যুৎ না থাকা ও সুপেয় পানির অভাব অন্যতম। সরেজমিন ১৩ নভেম্বর সকাল ১০টায় আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ নেই, তাই পুরো হাসপাতাল অন্ধকার। তারও তিন দিন আগে থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের সংযোগ লাইনে কাজ চলায় হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই। ফলে বন্ধ বিদ্যুৎভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা। নষ্ট হওয়ার পথে ফ্রিজে থাকা ইনস্যুলিন ও অন্যান্য পণ্য। এ সময় দেখা গেছে, রোগীরা বারান্দায় দিনের বেলায়ই অনেকটা অন্ধকারের মধ্যে বসে আছেন। হাসপাতালে সংকট আছে সুপেয় পানির। রোগীকেই কিনে আনতে হয় খাবার পানি। মুসলিম উদ্দিন নামের বহির্বিভাগের এক রোগী বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু সকাল থেকেই বিদ্যুৎ নেই। তাছাড়া, সেবা পেতে আমাদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। জরুরি বিভাগে গেলে বলা হয় বহির্বিভাগে যেতে, বহির্বিভাগে গেলে বলা হয় জরুরি বিভাগে যেতে।’ আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের বাসিন্দা মরিয়ম বেগম। রাতভর পেট ব্যথায় কাতরিয়ে সকাল ৮টায় চলে আসেন আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। জরুরি বিভাগে গেলে চিকিৎসক নেই বলে তাকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। এরই মধ্যে ব্যথায় অস্থির মরিয়ম। সাড়ে ৯টায় দেখা মিলল চিকিৎসকের। সকাল ১০টায় কথা হয় মরিয়মের সঙ্গে। তিনি বলেন, গতকাল রাতে ঘুমাতে পারি নাই পেট ব্যথার জন্য। তাই সকালেই চলে আসি। কিন্তু এসে চিকিৎসকের দেখা মিলল না। ৮টায় এসে সাড়ে ৯টায় চিকিৎসা পেয়েছি। কিছু টেস্টও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোথায় করাব তা জানি না।

সময়মতো চিকিৎসক না আসার অভিযোগ : আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা পাঁচজন রোগী এবং হাসপাতালের সামনের দুটি খাবারের দোকান ও একটি ফার্মেসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি এই সেবা কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান সমস্যা সময়মতো চিকিৎসকের না আসা। তিন-চারজন চিকিৎসককে নিয়মিত দেখা গেলেও বাকিদের দেখা মেলে না। সকাল সাড়ে ৮টায় হাসপাতালে আসার কথা থাকলেও অধিকাংশই আসেন ১০টার পর। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়ার কথা থাকলেও ১২টার পরই অধিকাংশ চিকিৎসক চলে যান। হাসপাতালের আন্তবিভাগের অধিকাংশ শয্যাই খালি। শিশু ওয়ার্ডে দেখা যায় দুজন রোগী। একাধিক রুম দেখা যায় তালাবদ্ধ।

হাসপাতালের সামনের একটি খাবারের দোকানদার হেলাল উদ্দিন বলেন, আজকেও (গত ১৩ ডিসেম্বর) একজন চিকিৎসক এসেছেন সাড়ে ১১টায়। অথচ সকাল ৮টা থেকেই রোগী আসা শুরু হয়। চিকিৎসক এক ঘণ্টা হাসপাতালে অবস্থান করে আবারও চলে যান। আর আউটসোর্সিংদের টাকা না দিলে মেলে না চিকিৎসা। নেই কোনো জবাবদিহি। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, চিকিৎসকদের সময়মতো না আসার বিষয়ে একাধিকবার কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিতে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে প্রতি মাসে ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রতিবেদন পাঠানোর নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না।

দীর্ঘদিন ধরেই নষ্ট এক্সরে মেশিন ও জেনারেটর : দীর্ঘদিন ধরেই নষ্ট হাসপাতালের একমাত্র এক্সরে মেশিনটি। ফলে সেবা বঞ্চিত রোগীরা। ২টার পর মেলে না ইসিজি সেবা। বিদ্যুৎ না থাকলেও মেলে না এ সেবা। ২০১৮ সালে চায়না থেকে আনা জেনারেটরটি এখনো বেহাল পড়ে আছে। এরই মধ্যে চলে গেছে ওয়ারেন্টি, নষ্ট হয়ে গেছে ব্যাটারি। গত ছয় বছরে একটিবারের জন্যও চালু করা যায়নি জেনারেটরটি। হাসপাতালে ১০টি জুনিয়র কনসালটেন্ট ও ১১টি মেডিকেল অফিসারের পদ আছে, এর মধ্যে চারটি শূন্য। নার্সের পদ আছে ৩৪টি, শূন্য তিনটি। চতুর্থ শ্রেণির ২৫টি পদ থাকলেও ১৩টি শূন্য এবং তৃতীয় শ্রেণির ৯৪টি পদ থাকলেও শূন্য ৫৪টি। আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মামুনুর রশিদ বলেন, গত তিন দিন ধরে পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ সরবরাহ লাইনের কাজ করছে। ফলে দিনের বেলায় বন্ধ রাখে বিদ্যুৎ। এ সময় হাসপাতালে বিদ্যুৎ না থাকায় নানা সমস্যায় পড়তে হয়। হাসপাতালে ডেডিকেটেড বিদ্যুৎ লাইন দিতে বলা হলেও তা দিচ্ছে না। সমস্যা আছে সুপেয় পানিতেও। নানা সমস্যা-সংকটের মধ্যে আমরা নিয়মিত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোগী চিকিৎসা নেয়, ৫০ শয্যার হাসপাতালে গড়ে ভর্তি থাকে ২০-৩০ জন। প্রতি মাসে নরমাল ডেলিভারি হয় প্রায় ৭০টির মতো। তিনি দাবি করেন, হাসপাতালের সব চিকিৎসক সময়মতো আসেন। তারা চিকিৎসাও দেন।

সর্বশেষ খবর