শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিরাপত্তা ব্যর্থতায় বারবার নাশকতা রেলে

► প্রত্যাহার করা হয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ► নির্দেশের পরও মোতায়েন হয়নি আনসার ভিডিপি

সাখাওয়াত কাওসার

নিরাপত্তা ব্যর্থতায় বারবার নাশকতা রেলে

একের পর এক ঘটেই চলেছে রেলপথে নাশকতার ঘটনা। নষ্ট হচ্ছে মহামূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ। দুষ্কৃতকারীদের এমন ভয়ংকর আয়োজনে মাঝেমধ্যেই বলি হচ্ছে তাজা প্রাণ। গত মঙ্গলবার ভোরে তেজগাঁও এলাকায় চলন্ত মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিকান্ডের ঘটনা সব ধারণাকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে একের পর এক দুর্ঘটনার পরও টনক নড়ছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের। উদ্বেগের খবর হলো, যেখানে সরকারের শত কোটি টাকা মূল্যের রেলগাড়ির নিরাপত্তা আরও জোরদার করা দরকার, সেখানে উল্টো যাত্রীবাহী রেলগাড়ি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) সদস্যদের।

অন্যদিকে, গত ১০ ডিসেম্বর রেল, সড়ক ও নৌপথের নিরাপত্তায় ১০ হাজার আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরও গতকাল পর্যন্ত তাদের সেবা পায়নি বলছে রেলপথ বিভাগ। জানা গেছে, ছয়টি জেলা নিয়ে রেলপথের নিরাপত্তায় কাজ করছে রেল পুলিশ। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী- ২২০০ জনবল থাকার কথা থাকলেও সেখানে রয়েছে ১৮০০। বর্তমানে প্রতিটি যাত্রীবাহী ট্রেনে ৩-৪ জন করে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানিয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। তবে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ে পুলিশের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় সম্পদের নিরাপত্তার বাইরে নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত সময় পার করেন। তাদের ম্যানেজ করেই স্মাগলাররা রেলকে অবৈধ পণ্য, মাদক এবং অস্ত্র পরিবহনের জন্য নিরাপদ বাহন হিসেবে মনে করে দীর্ঘদিন ধরে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক রেলওয়ে পুলিশের সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেছেন, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্যদের কারণে নিজেরা দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাদের দাবি, ট্রেনে দায়িত্বরত আরএনবিসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাই স্মাগলারদের সহযোগিতা করেন বিশেষভাবে ম্যানেজ হয়ে। এদিকে, রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক দিদার আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ছয়টি জেলায় বর্তমানে আমাদের ১৮০০ সদস্য দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিটি ট্রেনে ৩-৪ জন রেল পুলিশ থাকছে। রেল পুলিশের সঙ্গে আরএনবি, ওয়েম্যান, আনসার বাহিনীর সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। তবে আমরা এখনো আনসার হাতে পাইনি। খুব শিগগিরই হয়তো পাব। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোয় রেল পুলিশের ব্যর্থতা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সদস্যরা তাদের সর্বোচ্চটাই দিচ্ছেন। এরই মধ্যে গাজীপুরের ঘটনায় দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তেজগাঁওয়ের ঘটনায় জড়িতরা গ্রেফতার হবেন। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এ বিষয়ে কাজ করছে।

রেলপথ বিভাগ সূত্র বলছে, রেলপথ বিভাগের নিরাপত্তায় ৩৭০০ জন আরএনবি সদস্য থাকার কথা। তবে এর মধ্যে ৪২ শতাংশ পদই খালি। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ৫৭ শতাংশ। এর মধ্যে রেলপথ ঢাকা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৮১৭ জন আরএনবি সদস্য। তবে বর্তমানে কর্মরত মাত্র ৪০৪ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে থাকার কথা ৯০২ জন। কর্মরত রয়েছে মাত্র ৩০০ জন। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের বিস্তারিত বর্ণনা করা হলেও তার অনেকটাই কিতাবে বন্দি। আবার প্রতি বছর আরএনবির সদস্যদের দুই মাসের রিফ্রেশমেন্ট ট্রেনিংয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও তাও বাস্তবে দেখা যায় না।

রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট (ঢাকা) শহিদুল ইসলাম বলেন, জনবলের অনেক স্বল্পতা রয়েছে আরএনবিতে। এগুলো নিয়েই আমাদের দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার ঢাকা বিভাগে থাকার কথা ৮১৭ জন। রয়েছে মাত্র ৪০৪ জন। এ কারণে তাদের সময়মতো প্রশিক্ষণেও পাঠানো সম্ভব হয় না।

যাত্রীবাহী ট্রেন থেকে আরএনবি সদস্য প্রত্যাহার এবং প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এ ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তা করা হয়েছে। আগে প্রতিটি ট্রেনে অন্তত দুজন করে আরএনবি সদস্য দেওয়া হলেও গত কয়েক মাস ধরে তা দেওয়া হচ্ছে না। তারা কনটেইনার ট্রেন, গোস্ট ট্রেন, ইয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছেন। জনবল স্বল্পতার কারণে সময়মতো ট্রেনিংয়েও পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না।

যত নাশকতা : চলতি বছরের ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইল স্টেশনে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের দুটি কোচ দুষ্কৃতকারীরা পুড়িয়ে দেয়। ১৯ নভেম্বর জামালপুর সরিষাবাড়ী স্টেশনে দুষ্কৃতকারীরা ডব্লিউসিসি ট্রেনে দুটি কোচ পুড়িয়ে দেয় এবং একটি কোচ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ২২ নভেম্বর সিলেটে একটি ট্রেনে আগুন দেয়। ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর সেকশনের ২০ ফুট রেলওয়ের ট্র্যাক কেটে ফেলা হয়। এ কারণে নেত্রকোনাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ছয়টি কোচ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এলএম, এএলএমসহ অন্তত ২০ জন যাত্রী গুরুতর আহত হন। নির্মম মৃত্যু হয়েছে একজন যাত্রীর। সবশেষ গত মঙ্গলবার মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেয় দুষ্কৃতকারীরা। মা-শিশুসহ চারজন যাত্রীর নির্মম মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। তিনটি এসি কোচ সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও একটি বগি।

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য : অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, রেল রাষ্ট্রের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ খাত। অনেক দিন ধরেই আমরা দেখে আসছি দুর্বৃত্তরা আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে গণপরিবহন কিংবা রেলকে টার্গেট করছে। এজন্য রেলকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে কর্তৃপক্ষের দায়-দায়িত্ব প্রস্তুতি এবং সক্ষমতার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে কি না? তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। তবে সাম্প্রতিককালের ঘটনাগুলো আবারও রেলের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা আয়োজনে শূন্যতা কিংবা ভারসাম্যতাহীনতাই প্রকাশ করছে।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. আসিফ রায়হান বলেন, প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে দেশের যে কোনো জায়গাতেই রেললাইনে কোনো কিছু হচ্ছে কি না সেটা কম্পিউটারের সামনে বসেই জানা সম্ভব। তবে রেল কর্তৃপক্ষের এক্ষেত্রে অনীহা স্পষ্ট। রেল কর্তৃপক্ষ তো রেললাইন ও সংশ্লিষ্ট এরিয়াকে নিরাপদ রাখাটা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে লাইনের ওপর বাজার বসছে। মানুষ ও পশু বিচরণ করছে। এমন ব্যবস্থাপনায় যে কোনো ধরনের নাশকতার হুমকি তো থেকেই যায়।

সর্বশেষ খবর