বুধবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গার চাপে জীবিকা সংকটে স্থানীয়রা

কর্মক্ষেত্রে বিপর্যয় এড়াতে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও ইউএনএইচসিআরকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের চিঠি

মানিক মুনতাসির

মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের সম্পূর্ণ মানবিক বিবেচনায় স্থান দিয়েছিল বাংলাদেশ। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি করে নিরাপদ ক্যাম্প গড়ে তুলে তাদের সামাজিক পরিবেশ দিয়ে অস্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই রোহিঙ্গারাই এখন রীতিমতো স্থানীয়দের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারা কারণে-অকারণে স্থানীয়দের ওপর চড়াও হচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে এসে পরিচয় গোপন রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। যা স্থানীয়দের কর্মসংস্থানে বিপর্যয় আনতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। অর্থবিভাগ থেকে পাঠানো একাধিক নথি ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও অর্থবিভাগের নথিপত্রের তথ্যমতে, প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের জীবনধারণের জন্য জাতিসংঘ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা আর্থিক ও খাদ্য-সহায়তা দিয়ে আসছিল। কিন্তু করোনা মহামারি, বৈশ্বিক সংকট, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি আর্থিক ও খাদ্য-সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। ফলে রোহিঙ্গা নাগরিকরা নিজেদের চাহিদা মেটাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে চলে আসছে। কাজের খোঁজে তারা চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ঢাকায় এমনকি ভুয়া পাসপোর্ট বানিয়ে দেশের বাইরেও চলে যাচ্ছে। যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এতে করে চট্টগ্রাম এলাকার স্থানীয় লোকজনের ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অঞ্চলের স্থানীয়দের কর্মজীবনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরিস্থিতি বিচেনায় নিয়ে সমস্যা সমাধানে এবং কর্মক্ষেত্রে বিপর্যয় এড়াতে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও ইউএনএইচসিআরকে নভেম্বর-২০২৩ এর প্রথম সপ্তাহে চিঠি দেয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়। কিন্তু এসব সংস্থা থেকে এখনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা বোঝা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগীদের রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহায়তা বাড়ানো শীর্ষক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার কার্যপত্রে চট্টগ্রাম বিভাগকে রোহিঙ্গাদের জন্য হোস্ট কমিউনিটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মানবিক বিবেচনায় স্থান দিয়ে এই হোস্ট কমিউনিটিই এখন বেকার হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। সেজন্য এ অঞ্চলে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এমনকি যেসব এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প নেই সেসব এলাকায় এ প্রকল্প চালু করে হোস্ট কমিউনিটিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। একই সঙ্গে এ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় খাদ্য সংকট থেকে সামাজিক বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে শিবিরগুলোয় অভ্যন্তরীণ অসন্তোষও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা করা হয়। কেননা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় জাতিসংঘের খাদ্য-সহায়তার ফ্লো কমে গেছে। এ ছাড়া অনুদানের অর্থ কমে যাওয়ায় কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের যে আন্তর্জাতিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা চলতি বছর দুই ধাপে কমিয়ে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু আট ডলারে নেমে এসেছে। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি খাদ্য-সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে জাতিসংঘও। এ কারণে অর্থ সংকটে পড়েছে রোহিঙ্গারা। তিন মাসের ব্যবধানে ডব্লিউএফপি দুই দফা কমিয়েছে অর্থ বরাদ্দ। চলতি বছরের মার্চে রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি মাসিক বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়। সর্বশেষ গত ১ জুন থেকে ওই বরাদ্দ আরও কমিয়ে আট ডলার (৮৭০ টাকা) করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর