মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

বন্ধ হচ্ছে না অর্থ পাচার

পার পেয়ে যাচ্ছেন দোষীরা

মানিক মুনতাসির

পাচার বন্ধের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও কোনোভাবেই দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। আবার পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোও যাচ্ছে না। সম্প্রতি ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে পাচার বন্ধে কঠোর নীতি অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। একই সঙ্গে দেশ থেকে বিভিন্ন সময় পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রপ্তানি আয়ের অর্থ ঠিকমতো দেশে আসছে কি না, সেখানে আরও কড়া নজরদারি প্রয়োজন। প্রয়োজনে নীতি বা আইন-কানুন পরিবর্তনেরও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আবুল হাসান মাহমুদ আলীও অর্থ পাচার রোধ এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

এদিকে অর্থ পাচার রোধে কাজ করা বৈশ্বিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, দোষীদের কঠোর শাস্তি দিতে না পারলে পাচার বন্ধ সম্ভব নয়। আর কোনো দেশের সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করাও অসম্ভব। সংস্থাটি গত মাসের মাঝামাঝিতে বিদায়ী ২০২৩ বছরের কর্মকাণ্ডের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করেছে জিএফআই। অন্যথায় সংস্থাটির সঙ্গে চলমান ঋণ প্রকল্পের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় আটকেও যেতে পারে বলে জানানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাচার বন্ধে কঠোরতা দেখাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার পর কিছু নীতি পলিসিতেও পরিবর্তন আনা হবে বলে জানিয়েছে অর্থবিভাগ।

অন্যদিকে বাংলাদেশে চলমান টানা ডলার সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অর্থ পাচার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির হিসাব মতে, রপ্তানির একটা বিরাট অংশ দেশে আসে না। একইভাবে প্রচুর ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে বেআইনিভাবে টাকা পাচার করে নামে-বেনামে দেশের বাইরে সম্পদ গড়ে তুলছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। এদিকে প্রায় দেড় বছর আগে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী। যদিও সেটা তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। সম্প্রতি আর্থিক খাতের শুদ্ধতার জন্য অভিযান শুরু করে সিঙ্গাপুর, কানাডা, কাতার, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ। এতে বেশকিছু সম্পদ ও অর্থ পাচারকারীকে আটক করা হয়। সে সময় বাংলাদেশের অর্থ পাচারকারীদেরও নানারকম তথ্য প্রকাশ পায়। এটাকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সুযোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে একটি কৌশলপত্রও তৈরি করা হয়। তবে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া অর্থ ফেরত আনা কঠিন বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এখন সরকার চাইলে পাচারের অর্থ ফেরত আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- সরকার এর জন্য আদৌ কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না। জানা গেছে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে দেদার। ইতোমধ্যে পাচারকারী কিছু ব্যক্তির নামও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ছয়টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য এসেছে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপারস, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়ার প্রকাশিত সে দেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে কিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। জিএফআই সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ২০টি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা এই অর্থের বড় অংশই শীর্ষ ১০ দেশে গেছে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশেও অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে।

দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় পাচারের বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর