শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

কমেনি খেলাপি ঋণ

আলী রিয়াজ

কমেনি খেলাপি ঋণ

ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ কমাতে সরকার বড় ধরনের সংস্কারের ঘোষণা দেয় একাধিকবার। ব্যাংক কোম্পানি ও অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। খেলাপির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ শনাক্তে টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা করে। তবে এসব উদ্যোগ ঘোষণায়ই শেষ। গত কয়েক বছরে সরকার ব্যাংক খাতে বড় ধরনের কোনো সংস্কার তো নেয়নি, বরং ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। সর্বশেষ ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অনিয়ম, সংকটের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। দৈনন্দিন লেনদেন করার মতো পর্যাপ্ত তহবিল নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে চলতে হচ্ছে। ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার জন্য দায়ী সরকারের অবহেলা। খেলাপিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেওয়ার পরিণতি এখন ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে। বড় আকারের সংস্কার ছাড়া ব্যাংকিং খাতের সংকট যাবে না বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা। ২০১৯ সালে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও মূলধন ঘাটতি পূরণে শর্ত আরোপ করা, ব্যাংকারদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সংস্কারমূলক কাজ শুরু করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ রাষ্ট্রায়ত্তসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষকেও যুক্ত করে। ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংকের কাছে কয়েকটি তথ্য চেয়ে চিঠিও দেওয়া হয়। চিঠিতে বিগত সময়ে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ এবং আগামীতে খেলাপি কমিয়ে আনার বিষয়ে তাদের সুপারিশ চাওয়া হয়। এফআইডির উদ্যোগের মধ্যে আরও ছিল ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে বাজেট থেকে এ পর্যন্ত কত টাকা দেওয়া হয়েছে সে হিসাব জানতে চাওয়া। সংস্কারের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডিদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বৈঠকে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর কৌশল, আইন সংশোধন, নতুন ব্যাংক অনুমোদনে কঠোর বিধানসহ নানা বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংকিং খাত সংস্কারে শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠনের কথাও বলা হয়। খেলাপি হওয়া ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ, খেলাপিকে শনাক্ত, রাইট অফ (অবলোপন) ঋণ পর্যালোচনা, ঋণ ফেরত না পাওয়ার পেছনে কারণ কী এবং কে দায়ী তা-ও শনাক্তে কাজ করবে টাস্কফোর্স। খেলাপি ঋণের পেছনে সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা আছে কি না, কর্মকর্তাদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা আছে কি না খতিয়ে দেখবে কমিটি। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধন করে খেলাপি ঋণের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার কথা বলা হয়। তবে এসব উদ্যোগ কার্যকর হয়নি গত পাঁচ বছরে। উল্টো ব্যাংকিং খাতের জটিলতা আরও গভীর হয়েছে। ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ লাগামছাড়া ছিল। দেশের ব্যাংক খাতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটিতে। ২০০৯ সালে দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। গত ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ প্রায় ৭ গুণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে নানা লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হলেও তাতে তেমন সাড়া মিলছে না, বরং নতুন নতুন ঋণ খেলাপির ঝুঁকিতে পড়ছে। এর বাইরে সারা বছর শরিয়াভিত্তিক বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংককে তারল্যসংকটের চরম অবনতি দেখা গেছে। কিন্তু বেনামি ঋণ ও ঋণ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংস্কার হয়নি। যার ফলে আজ আমরা এ অবস্থা দেখছি। আবার যখন দেখলাম কিছু জায়গায় সংস্কার করা হলো, তখন তা উল্টো দিকে গেল। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের লোকজনের আধিপত্য এখনো রয়ে গেছে। এগুলো পুরোপুরি উল্টো পথে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাংক।’ তিনি বলেন, ‘সংস্কার করতে গেলে সদিচ্ছার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী জ্ঞান ও ধারণা থাকতে হবে। শুধু তথ্য-উপাত্ত দেখে নীতিমালা করলে হবে না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর