শিরোনাম
শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

চোখ রাঙাচ্ছে বায়ুদূষণ হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

গড় আয়ু কমছে ৭ বছর ৭ মাস, বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ

জিন্নাতুন নূর

বায়ুদূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। দূষণ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ছুটির দিনেও এখন রাজধানী ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ থাকছে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষ আগের চেয়ে বেশি শ্বাসতন্ত্রের রোগে ভুগছে। এ কারণে বিভিন্ন রোগে ভুগে মানুষের গড়আয়ুও কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বায়ুদূষণ এখন ঢাকাসহ দেশবাসীর ওপর চোখ রাঙাচ্ছে। এতে হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন,  বায়ুদূষণ যত বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও তত বাড়ছে। এ কারণে গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষসহ শ্বাসকষ্টের রোগীদের বেশি ভুগতে হচ্ছে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৩ সাল ছিল গত আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর। ২০২৩ সাল বায়ুমান সূচকে ঢাকার গড় স্কোর ছিল ১৭১, যা আগের বছর ছিল ১৬৩। সাধারণত বায়ুমান সূচকে নম্বর ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, বায়ুমান সূচকে ঢাকার বায়ু কখনো কখনো ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থাতেও পেঁৗঁছে যাচ্ছে। তখন বায়ুমান সূচকে স্কোর ২৮১ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত কয়েক মাস ধরেই মেগা সিটি ঢাকা মাসের বেশির ভাগ দিনগুলোতে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। এমনকি ছুটির দিনেও ঢাকার বায়ুর মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ থাকছে। ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। পরিবেশবিদ ড. আতিক রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বায়ুদূষণ বলতে এখন যা দেখতে পাচ্ছি সেটি আসলে ধুলো এবং অতি ক্ষুদ্র কণা যা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। শহরে যে ধুলা উড়ে বেড়াচ্ছে তা বৃষ্টি বা পানির মাধ্যমে সরানোর কোনো উপায় নেই। ঢাকার আশপাশে আমাদের নদীগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এর ফলে ধুলা আটকানোর মতো কোনো ব্যবস্থাও এখন নেই। এতে বায়ুদূষণ বেড়েই চলছে। ক্যাপস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে ঢাকার বায়ুমান স্কোর চার বছর (২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২০) সংবেদনশীল গোষ্ঠীর (শিশু, প্রবীণ) জন্য অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে ছিল। সর্বশেষ তিন বছরসহ বাকি পাঁচ বছর ছিল অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। সমস্যা হচ্ছে, ২০২০ সালের পর থেকে ঢাকার গড় বায়ুমান স্কোর বাড়ছে। অর্থাৎ দূষণ বাড়ছে। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। শীতে ঢাকার বায়ুর মান বেশি খারাপ থাকে। ক্যাপসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আট বছরে ২০২২ সাল ছাড়া প্রতি বছরই জানুয়ারি মাসে বায়ুর মান বেশি খারাপ ছিল।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যে, বায়ুদূষণ রোধে সরকার ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুটি প্রকল্পে অন্তত সাড়ে ৬ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করে। নতুন করে বায়ু, পানিদূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার ‘বাংলাদেশে টেকসই পরিবেশ ও রূপান্তর’ শিরোনামে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এতে ২৫ কোটি ডলার অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও বায়ুদূষণ কমানোর জন্য কোনো প্রকল্প সেভাবে দৃশ্যমান নয়। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চিহ্নিত করার জন্য সুবিধা বাড়ানো দরকার। অবৈধ ইটভাটা নজরদারি করে এর বিকল্প ব্যবহার নিয়ে আসা উচিত। এ ছাড়া পোড়ানো ইটের বদলে ব্লক ইটের ব্যবহার উৎসাহিত করা উচিত। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যাওয়া বক্ষব্যাধির রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০২২ সালে হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে রোগীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৫৯ জন। আর ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ১১ মাসে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাজার ৩৭৩ জন। চিকিৎসকরা মনে করছেন, বায়ুদূষণ এর অন্যতম একটি কারণ। তাদের মতে, এখন শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। গবেষণায় দেখা যায়, বায়ুদূষণের কারণে দেশে পাঁচজনে একজনের মৃত্যু হয়। এজন্য অকালমৃত্যুর হার প্রায় ২০ শতাংশ। মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়ুদূষণ। এজন্য মানুষ শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যান্সার, অ্যাজমা, অ্যালার্জি ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

কেন বাড়ছে বায়ুদূষণ : ঢাকা শহরে বছজুড়েই চলে রাস্তা খোঁড়ার কাজ। এর সঙ্গে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ লেগেই থাকে। ঢাকার আশপাশেই সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলো এখনো চলছে। এসব ভাটায় কয়লা, কাঠ ব্যবহারে দূষিত হচ্ছে বায়ু। পাশাপাশি শিল্পকারখানায় বায়ুদূষণ হচ্ছে। শহরে চলা বাসগুলোর বেশির ভাগই পুরনো। এসব যানবাহনও দূষণ ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া শীতে ভারতের দিল্লি হয়ে দূষিত বায়ু মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে দেশে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজের জন্য ৩১ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ৩১ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, গৃহস্থালি থেকে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়। বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে আসে। ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য রাস্তার ওপর অনেক র‌্যাম্প তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক সময় নির্মাণবিধি মেনে কাজ হয়নি। এখন থেকে প্রচুর ধুলাবালি সৃষ্টি হয়। ঢাকার চারপাশে ইটভাটাগুলো ব্যাপকহারে পরিবেশ দূষণ করছে। বায়ুদূষণ যত বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও তত বাড়ছে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষসহ শ্বাসকষ্টের রোগীদের বেশি ভুগতে হচ্ছে। এতে একদিকে চিকিৎসা খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষের কর্মক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর