রবিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষ্য আইনেই বিচার

♦ রহিতকরণের সুপারিশ আইন কমিশনের ♦ নতুন খসড়াও প্রস্তুত করেছে সংস্থাটি

আরাফাত মুন্না

যুগ যুগ ধরে ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষ্য আইন দিয়েই চলছে দেশের বিচারিক কার্যক্রম। আইনের বিভিন্ন সংজ্ঞা, প্রয়োজনীয় মৌলিক নীতি ও এর বিভিন্ন তত্ত্বগত, তথ্যগত, পদ্ধতিগত বিভিন্ন অধ্যায় এবং ধারায় থাকা ত্রুটি ও অস্পষ্টতা চিহ্নিত করে ১৮৭২ সালে প্রণীত সাক্ষ্য আইনটি রহিতকরণের সুপারিশ করেছে আইন কমিশন। একই সঙ্গে যুগোপযোগী ও ত্রুটিমুক্ত নতুন সাক্ষ্য আইনের খসড়াও প্রস্তুত করেছে সংস্থাটি। নতুন সাক্ষ্য আইনে খসড়ায় তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাক্ষ্যগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে খসড়ার একটি অনুলিপি আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়েছে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিশন এই খসড়া প্রস্তুত করেছেন। কমিশনের অন্য দুই সদস্য হলেন- সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর।

জানা গেছে, বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনটি ব্রিটিশ আমলে ১৮৭২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। পরবর্তীকালে এই আইনটি ভারতীয় সাক্ষ্য আইন নামে অভিহিত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর ভারতীয় শব্দটি সাক্ষ্য আইন থেকে বিলুপ্ত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনটি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় অন্যতম পদ্ধতিগত আইন হিসেবে বিভিন্ন বিচার আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, যুগ ও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ ও সামাজিক বিরোধের ধরন ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বিরোধ ও অপরাধের বিস্তৃতি লাভ করছে। তাই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনসহ অন্য আইনগুলোকে আরও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন, যাতে বর্তমান সময়ে উদ্ভূত বিরোধ ও অপরাধের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। নতুন সাক্ষ্য আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে আইন কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা (জেলা জজ) ড. মোহাম্মদ মোরশেদ ইমতিয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রস্তাবিত নতুন সাক্ষ্য আইনটি পুরো বাংলা ভাষায় করা হয়েছে। এ ছাড়া বিচারপ্রার্থী ও সংশ্লিষ্টদের বোধগম্য করতে ভাষাও সহজ করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন আইনে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের বিধান আরও স্পষ্ট করা হয়েছে। তিনি বলেন, আইনে কিছু নতুন ধারা সংযোজনের পাশাপাশি প্রচলিত ধারাগুলোতেও নানা ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনে পর্যাপ্ত সংখ্যক উদাহরণ যুক্ত করার মাধ্যমে আইনটি যুযোপযোগী করা হয়েছে বলে জানান তিনি। খসড়া পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রস্তাবিত খসড়ায় নতুন সাক্ষ্য আইনটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আইনটিতে ১৯টি অধ্যায় এবং ১৮০টি ধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সাক্ষ্য আইনের খসড়ায় দোষ স্বীকারোক্তির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দলিল বলতে অডিও, ভিডিও, ডিজিটাল নথিসমূহ, যে কোনো ধরনের ডিজিটাল উপাত্ত, কম্পিউটার কার্যক্রম, শব্দ বা চিত্র ধারণকারী যে কোনো ধরনের ডিস্ক বা টেপ ও অন্য যে কোনো প্রকার উপাত্ত ধারক, ডিজিটাল স্বাক্ষর, সার্টিফিকেট ও ডিজিটাল মাধ্যমে কৃত যোগাযোগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত খসড়ায় মৃত্যুকালীন ঘোষণার বিধানটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, উক্ত ব্যক্তি যদি তার আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা করে এবং উক্ত আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা হতেই যদি সে বক্তব্যটি প্রদান করে তাহলে যে কার্যধারায় তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে তার প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন, সে বক্তব্যসমূহ প্রাসঙ্গিক। বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনকে বদলে নতুন আইনের খসড়া সম্পর্কে কমিশন বলছে, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ও বাংলাদেশের বর্তমানে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ও বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থা বিশদ পর্যালোচনা করে আইন কমিশন এই খসড়া প্রস্তুত করেছে। প্রস্তাবিত সাক্ষ্য আইন প্রণয়ন করা হলে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ সামগ্রিক বিচার কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে আইনটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। খসড়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘অভিযুক্তের সাংবিধানিক ও প্রচলিত অন্যান্য আইনে স্বীকৃত অধিকার রক্ষা করে আইনানুগভাবে আদালতের সম্মুখে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা প্রয়োজন। পক্ষগণ কর্তৃক যথেচ্ছ অপ্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন রোধ এবং কেবল প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহের সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে সাক্ষ্য আইনের গুরুত্ব অপরিসীম। একই ধরনের মামলায় বিভিন্ন আদালত যাতে বিভিন্ন রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ না করেন তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’ কমিশন বলেছে, পরিস্থিতি বিবেচনায়, কতিপয় সাক্ষ্য গ্রহণ বা বর্জন বিষয়ে আদালতের সুবিবেচনামূলক ক্ষমতার প্রয়োজন। অপ্রাসঙ্গিক ও পক্ষপাতমূলক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যেন কোনো ব্যক্তি তার আইনি অধিকার বঞ্চিত না হয় বা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির সাজা না হয় তা নিশ্চিতকল্পে আদালতে সঠিকভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ ও ব্যবহার সম্পর্কে যুগোপযোগী সাক্ষ্য আইন আবশ্যক। সর্বোপরি একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য আইনানুগ পদ্ধতিতে সাক্ষ্য উপস্থাপন ও বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নিশ্চিতকল্পে সাক্ষ্য আইনের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

নতুন খসড়া তৈরির আগে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা, উচ্চ আদালতের সাবেক বিচারপতি, জেলা জজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবীসহ সাড়ে ৩০০ অংশীজনের মতামত আহ্বান করা হয়। এদের অনেকেই আইন কমিশনের আহ্বানে তাদের মতামত দেন। সেই মতামত পর্যালোচনা করে কমিশন এই খসড়া প্রণয়ন করেছে। কমিশন বলছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বর্তমান সাক্ষ্য আইনটি ইংরেজিতে প্রণীত হয়ে অদ্যাবধি বহাল থাকায় বেশির ভাগ সময়েই তা বিচারপ্রার্থী জনগণের বোধগম্য হয় না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ফলে বাংলা ভাষায় আইন প্রণয়নের গুরুত্ব কোনো ?মেই উপেক্ষা করা যায় না। তাছাড়া, ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ অনুসারে বাংলা ভাষায় আইন প্রণয়ন করার আইনগত বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। বাংলা ভাষায় নতুন সাক্ষ্য আইন প্রণয়ন করা হলে সে ক্ষেত্রে এটা সহজবোধ্য ও ব্যবহার উপযোগী হওয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের পথ সুগম করবে। আইন কমিশন দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনটি প্রয়োজনীয় পরিমার্জনের মাধ্যমে নতুন করে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষায় প্রণয়ন ও প্রবর্তনে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সর্বশেষ খবর