সোমবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নষ্ট হচ্ছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা

রয়েছে বেদখল, চূড়ান্ত তালিকা নেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের

হাসান ইমন

নষ্ট হচ্ছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা

পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর মধ্যে রূপলাল হাউস অন্যতম। হাউসের সামনে ছোট্ট করে বিলবোর্ডে লেখা ‘জামাল হাউস’। এর বিভিন্ন স্থান ভেঙে পড়েছে। ভবনের সামনে ছাদে-কার্নিশে এবং অন্যান্য স্থানে বটগাছ গজিয়েছে। এমন জরাজীর্ণ অবস্থায়ও বিভিন্ন কোঠায় মানুষ বসবাস করছে। নিচের কোঠাগুলোতে বানানো হয়েছে মসলার আড়ত। ভবনটির চারদিকে পিঁয়াজ, রসুন, আদাসহ নানারকম মসলার বস্তা রাখা।

বুড়িগঙ্গার পাড়ে এভাবেই জীর্ণশীর্ণভাবে দাঁড়িয়ে আছে একসময়ের অভিজাত ও রাজকীয় আবাসন ভবনটি। স্থাপত্য নকশায় বাহ্যিক দৃষ্টিতে এ ভবনটিতে যথেষ্ট বৈচিত্র্য এবং কারুকাজ দেখা গেলেও শতবর্ষী ভবনটি এখন অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।

জানা গেছে, অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ভবনটি নির্মাণ করেন ব্যবসায়ী ভ্রাতৃদ্বয় রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। রূপলাল দাস তার পরিবারসহ বসবাসের জন্য ইমারতের নকশা তৈরি করেন। গ্রিক স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত এর বিশাল ডরিক কলাম, যা ঢাকা শহরের আর কোথাও দেখা যায় না। অতঃপর তার উত্তরাধিকারীরা প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন সময় এ ইমারত ধীরে ধীরে রূপলাল হাউসের সম্প্রসারণ কাজ করতে থাকেন। আঠারো শতকের শেষের দিকে রূপলাল হাউস হয়ে ওঠে ঢাকার বিলাসী ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর জৌলুসে ভরা বাসভবন। তবে সংস্কারের অভাবে একসময়ের জৌলুস ভরা এ বাসভবনটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।

পুরান ঢাকার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী মুঘল স্থাপত্য বড় কাটরার একটি অংশ ২০২২ সালের জুলাই মাসে ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চকবাজারের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীরে মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন বড় কাটরা। ইমারতটি আয়তাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। ১৬৪৪ সালে শাহ সুজার বাসস্থান হিসেবে নির্মাণ করা হয় এ কাটরা। এতে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর সব বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ইমারতটির বিভিন্ন অংশ বর্তমানে বিলুপ্ত। দক্ষিণের আদি অংশটুকু অক্ষত রয়েছে। যদিও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকায় ২ নম্বরে রয়েছে বড় কাটরা। ২০২০ সালে তালিকায় থাকা স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। আবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে সংরক্ষিত পুরাকীর্তির খসড়া তালিকায় ১৪ নম্বরে রয়েছে বড় কাটরা। সে অনুযায়ী, দুটি সংস্থাই ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনা সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। প্রত্নসম্পদ আইন অনুযায়ী, কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে সরকার চিহ্নিত করলে সেটি ভাঙা যাবে না; সংরক্ষণ করতে হবে। কেউ সেটি সংরক্ষণে অক্ষম হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে জানাতে হবে। অধিদফতর সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবে। আবার সরকার চাইলে সংরক্ষণের জন্য ওই স্থাপনাসহ জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে।

শুধু রূপলাল হাউস ও বড় কাটরা নয়, আহসান মঞ্জিলও নষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি পুরান ঢাকার অন্তত কয়েকটি শতবর্ষী ভবন ঘুরে দেখা গেছে, ঐতিহাসিক এসব স্থাপনার অনেকগুলো গুদাম ও কারখানা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কোনোটিতে রয়েছে ৩০টির বেশি পরিবার। কোনোটি দখলে আবার কোনোটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। কোনোটি আবার সংরক্ষিত হিসেবে তালিকাভুক্তির পরও ঘটছে ভবন ভাঙার ঘটনা। সব স্থাপনায় অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা সংগঠন আরবান স্টাডি গ্রুপের (ইউএসজি) তথ্য অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী ভবন আছে ২ হাজার ২০০টি। এসব বাড়িকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে রিট করেছিল সংগঠনটি। এসব বাড়ি অক্ষত রেখে সেগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য নির্ণয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে ২০১৮ সালে নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। মাঠপর্যায়ে জরিপ করে সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন ছয় বছরেও দাখিল করতে পারেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। একই সঙ্গে সর্বশেষ ২০২০ সালে পুরান ঢাকার ৭৪টি স্থাপনাকে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বিধি অনুযায়ী, এসব স্থাপনা ও এসব এলাকায় অবস্থিত ইমারত, উন্মুক্ত জায়গা, রাস্তা ও গলির প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংস্কার, অপসারণ ও ধ্বংসের ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, ঢাকা জেলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা জরিপ কাজ চলছে। খসড়া হিসেবে ঢাকা বিভাগে ১০৩টি স্থাপনা রয়েছে। তবে এগুলো এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। এর মধ্যে কিছু স্থাপনার আংশিক দখলে রয়েছে। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। আরবান স্টাডির প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বলেন, অধিদফতর এত বছরেও প্রতিবেদন না দেওয়ায় সংকটের সমাধান হয়নি। ঐতিহাসিক এসব স্থাপনা নষ্ট হওয়াও থেমে নেই। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন বহু বাড়ি ভাঙা হয়েছে, যেগুলো তালিকাভুক্ত হতে পারত। এ ছাড়া কিছু ভবন সংস্কার করা হয়েছে যেগুলো পুরনো নকশার সঙ্গে কোনো মিল নেই। দেখে মনে হবে এগুলো নতুন ভবন। পুরনো কোনো ঐতিহ্যের চিহ্ন নেই।  আমেরিকার একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আমেরিকার ওকালাহামায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটি সভা হয়েছে। যে ভবনটিতে সভা হয়েছে সেটা ছিল শতবর্ষীয় পুরনো অডিটরিয়াম। সেটার ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে তারা অডিটরিয়ামের কার্যক্রম ঠিক রেখেছে। একই সঙ্গে তারা ঐতিহ্যবাহী ভবন সম্পর্কে সভায় আগত অতিথিদের অবহিত করেছে। আমরাও লালকুঠি ভবনের অডিটরিয়ামকে ঐতিহ্যবাহী হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম।

সর্বশেষ খবর