শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নড়াই নদী এখন রামপুরা খাল

রামপুরা ব্রিজ থেকে মেরাদিয়া পর্যন্ত দখল-দূষণে বিপর্যস্ত

হাসান ইমন

নড়াই নদী এখন রামপুরা খাল

একসময়ের প্রবহমান নড়াই নদী কালের বিবর্তনে এখন হয়েছে সরু খাল। এই সরু খালটি এখন রামপুরা খাল হিসেবে পরিচিত। যদিও আশির দশকে এই নদীপথটি ব্যবসাবাণিজ্যের অন্যতম একটি রুট ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে মালামাল আসত নৌকা করে। সেসব আজ অতীত। নৌকা দু-একটা এখনো চলে বটে, কিন্তু রামপুরা খাল হারিয়েছে তার জৌলুস। সময়ের ব্যবধানে দখলে-দূষণে নড়াই এখন মৃত খালে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নথিতেও নদী বাদ দিয়ে খালের নাম উপাধি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, আশির দশকের শুরুর দিকেও নদীর পশ্চিমাংশ কারওয়ান বাজার পর্যন্ত নৌপথ চালু ছিল। একসময় এ নড়াই নদী দিয়ে হাতিরঝিল হয়ে নৌপথে শাকসবজিসহ অন্যান্য মালামাল কারওয়ান বাজার যেত। কারওয়ান বাজারে বিজিএমইএ ভবনের পাশে মাছের পাইকারি বাজারটিতে একসময় শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদের মাছের ল্যান্ডিং পোর্ট ছিল। বর্তমানে সরকারি খাতায় এই নদীটির নাম রয়েছে রামপুরা বা বেগুনবাড়ি খাল হিসেবে। এই খালে মগবাজার, মধুবাগ, উলন, দাসপাড়া, রামপুরা, খিলগাঁও, মেরুল, বাড্ডা, বেগুনবাড়িসহ আশপাশ এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতো। বর্তমানে হাতিরঝিল প্রকল্পের পানি পাম্পের মাধ্যমে এ খালের পানি নিষ্কাশন করা হয়। তাছাড়া ঝিলের অতিরিক্ত পানিও রামপুরা ব্রিজ হয়ে এ খালে পড়ে।

সরেজমিন দেখা গেছে, রামপুরা ব্রিজের ওপরের বিশাল অংশ দখল করে একটি রাজনৈতিক দলের রামপুরা থানা কার্যালয় বানানো হয়েছে। এর পাশেই রয়েছে ঢাকা ওয়াসার একটি পাম্প ও ডিএনসিসির সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস)। অন্যদিকে আফতাবনগর অংশে সীমানা দেয়াল পার হয়ে খালের মধ্যে মাটি ভরাট করে শাকসবজির খেত তৈরি করেছেন খালপাড়ের বাড়ির মালিকরা। ফলে দিন দিন নাব্য হারিয়ে খালটি পরিণত হচ্ছে সরু ড্রেনে। ময়লা-আবর্জনা আর কচুরিপানার কারণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে খালটি। সড়ক সম্প্রসারণের নামে খালপাড় থেকে ৭ থেকে ১০ ফুট দখল করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। বনশ্রী বি ও সি ব্লকসংলগ্ন স্বপ্নের সামনের বিশাল অংশ দখল করে বাসাবাড়ির বর্জ্য ফেলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন করে খালের অনেকটা জায়গা ভরাট করা হয়েছে। যেখানে বস্তাভর্তি ময়লা-আবর্জনা রাখা ও মাছের আঁশ শোকাতে দেখা গেছে। আফতাবনগর-বনশ্রী যাতায়াতের জন্য খালের ওপর বাঁশ দিয়ে পুল নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁশের গোড়ায় বর্জ্য জমে পানিপ্রবাহ বন্ধ হতে চলেছে। খালের মেরাদিয়া বাজার অংশে কাঁচা মালামালের উচ্ছিষ্ট ফেলে ভরাট করা হচ্ছে।

মেরাদিয়া হাটের বিপরীতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লা রাখার সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থাকলেও বর্তমানে অনেকটা অকেজো। এই এসটিএসের দেয়ালে জানালার মতো ছিদ্র রয়েছে। যেগুলো দিয়ে প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনা খালে পড়ছে। একই সঙ্গে এ এসটিএসের দুই পাশে বিভিন্ন রকম ময়লা খালে পড়ছে। এ ছাড়া খালপাড় ঘেঁষে একশ্রেণির অসাধু চক্র অবৈধ ২০-২৫টি দোকান বসিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি দোকানে ছাগল জবাই করে বিক্রি করা হয়। আর এসব বর্জ্য খালে ফেলে দেয় দোকানিরা। এ ছাড়া খালের দুই পাশে বাড়ির ভাঙা অংশের ইট-সুরকিসহ বিভিন্ন স্থাপনা বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হচ্ছে।

জানা যায়, রাজধানীর পূর্বদিকের বালু নদ থেকে পশ্চিম দিকের তুরাগ নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল নড়াইয়ের ধারাটি। বর্তমানে এর পশ্চিমাংশ পুরোই ভরাট করা হয়ে গেছে। মাঝের অংশটি হাতিরঝিল নামে পরিচিত। তবে একেবারে পূর্বদিকের অংশটি এখনো প্রবহমান এবং স্থানীয়ভাবে নড়াই নদী নামেই পরিচিত। তবে সরকারি কাগজপত্রে নদীর পূর্বাংশের অংশ খাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দখলে-দূষণে মৃতপ্রায় নড়াই নদীকে খাল উল্লেখ করায় নিন্দা জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। গত বছরের অক্টোবর মাসে ‘নোঙর বাংলাদেশ’ রামপুরা বনশ্রী-সংলগ্ন নদীর তীরে ‘নড়াই নদী’র নাম ফলক উন্মোচন এবং নৌকা র‌্যালির আয়োজন করেছিল। সেখানে নদীর নাম বাদ দিয়ে খাল হিসেবে চিহ্নিত করায় প্রতিবাদও করেছিল সংগঠনটি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নোঙর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুমন শামস বলেন, রামপুরা খাল নয়, এটার নাম নড়াই নদী। এই নদী রক্ষায় আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। শুনেছি এই নদীর দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। কিন্তু কোনো মেয়রের এই নদী নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। বর্তমানে দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত। এ নদী রক্ষায় দরকার মেয়র, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলরদের এক জায়গায় আসা। এক জায়গায় আসতে পারলে এই নদীসহ সব নদী খাল উদ্ধার হবে ও সংরক্ষণ হবে। তা না হলে যত প্রকল্পই নেওয়া হোক না কেন, অর্থের অপচয় ছাড়া কোনো লাভ হবে না।

যদিও বর্তমানে রামপুরা খালটি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন রয়েছে। এর মধ্যে রামপুরা ব্রিজ থেকে ফরাজী হাসপাতাল পর্যন্ত ঢাকা উত্তরের আওতাধীন এবং সেখান থেকে বালু নদ পর্যন্ত দক্ষিণের আওতাধীন। যদিও মেরাদিয়া বাজার পর্যন্ত খালটির অবস্থা খুবই করুণ। এ বিষয়ে দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলেন, ঢাকা উত্তরের অংশে খাল সংস্কারে পরিকল্পনা রয়েছে। দখল ও দূষণ বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবেন। আর দক্ষিণের খাল সংস্কারে কোনো পরিকল্পনা নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর