বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
রোমহর্ষক বর্ণনা

তিন খুনের রহস্য উদঘাটন

সিরাজগঞ্জে মা-বাবা মেয়ে খুনে মূল আসামি ভাগনে আটক, ছিলেন ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

তিন খুনের রহস্য উদঘাটন

রাজীব ভৌমিক

সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বাবা-মা ও মেয়েকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে জড়িত বিকাশ সরকারের বড় বোনের ছেলে আপন ভাগনে রাজীব ভৌমিককে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। আর্থিক কারণে ভাগ্নে রাজিব কুমার ভৌমিক হতাশাগ্রস্ত হয়ে তার মামা-মামি ও মামাতো বোনকে গলা কেটে হত্যা করেছে বলে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল জানিয়েছেন। আটক রাজীব ভৌমিক উল্লাপাড়া উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের মৃত বিশ্বনাথের ছেলে।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল জানান, তাড়াশের বারোয়ারী বটতলা নিজ বাড়ির তিন তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে মঙ্গলবার সকালে বিকাশ সরকার, তার স্ত্রী স্বর্ণা সরকার ও একমাত্র মেয়ে তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী পারমিতা সরকার তুষির গলা কাটা অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। মর্মান্তিক ও চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন ও আসামিকে গ্রেফতারের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সামিউল আলমের নেতৃত্বে পুলিশ ও ডিবির ২০ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়। নিরলস পরিশ্রমের কারণে হত্যাকাণ্ডের ১২ ঘণ্টার মধ্যে রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে এবং আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জানান, প্রথমে হত্যাকাণ্ডের শিকার বিকাশ সরকারের একটি মোবাইল রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়। রেকর্ডের একপ্রান্তে বিকাশ সরকার এবং অন্যপ্রান্তে ভাগ্নে রাজিব ভৌমিকের কিছু কথোপকথন শোনা যায়। এর সূত্র ধরেই রাজিব কুমার ভৌমিককে বিকালে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর রাজীব কুমার ভৌমিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একাই জড়িত বলে স্বীকার করে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন। আসামি রাজিবের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, আসামি রাজিব ভৌমিকের বাবা ২০১৯ সালে মারা যায়। এরপর থেকেই রাজিব পরিবারের হাল ধরেন। একই সঙ্গে তার মামা বিকাশ সরকারের সঙ্গে খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় বিকাশ সরকার ভাগ্নে রাজিবকে ২০ লাখ টাকা প্রদান করেন। রাজিব পর্যায়ক্রমে মামাকে ২৬ লাখ টাকা ফেরত দিলেও বিকাশ সরকার আরও ৩৬ লাখ টাকা পাবেন বলে দাবি করেন। আর টাকার জন্য বোন এবং ভাগিনা রাজিবকে বারবার তাগাদা দেন। সর্বশেষ গত বুধবার ভাগ্নে রাজিব ও তার মাকে বকাঝকা করেন। এ ছাড়াও এনজিও থেকে মায়ের নামে সুদে টাকা তোলায় হতাশায় ভুগছিল রাজিব কুমার ভৌমিক। এসব কারণেই ক্ষুব্ধ ও হতাশায় পড়ে রাজিব তার মামাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মাফিক রাজিব শনিবার বিকালে প্রথমে মামাকে ফোন করে বলেন টাকা ফেরত দেব, আমি আপনার বাসায় যাচ্ছি আপনি বাসায় আসেন। ওই সময় বিকাশ তাকে বাড়িতে গিয়ে বসতে বলেন। তখন রাজিব বাড়ি থেকে ব্যাগের মধ্যে একটি হাঁসুয়া ও স্থানীয় প্রতাপ বাজারের দোকান থেকে তিন কেজি ওজনের একটি রড কিনে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে তাড়াশে মামার বাড়িতে যায়। বাড়িতে ঢোকার পর মামি স্বর্ণা রানী তাকে বসতে বলেন এবং ভাগ্নেকে কফি খাওয়ানোর জন্য তিনতলা থেকে নিচে নেমে কফি কিনতে বাইরে দোকানে যান। এ সময় রাজিবের মামাতো বোন পারমিতা সরকার তুষি টাকার লেনদেনের বিষয়টি তুলে বলে ভাইয়া আপনি টাকা দিচ্ছেন না কেন? এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হয়। টাকাগুলো দিয়ে দেন। এতে রাজিব ক্ষুব্ধ হয়ে পারমিতা সরকার তুষির মাথায় রড দিয়ে আঘাত করলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এরপর মামি কফি নিয়ে ঘরে ঢুকে পারমিতা সরকার তুষির রুমের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকেও রড দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলে। এর ১০ মিনিট পর মামা বিকাশ সরকার দরজায় নক করে। এ সময় রাজিব দরজা খুলে দেওয়ার পর বিকাশ সরকার ঘরে ঢোকামাত্রই তাকে রড দিয়ে আঘাত করে ও ব্যাগ থেকে হাঁসুয়া বের করে একে একে তিনজনকে জবাই করে ঘরে তালা লাগিয়ে বের হয়ে যায়। মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি যাওয়ার পথে চালমাগুড়া এলাকায় উৎপল সরকারের পুকুরে রড ফেলে দেয় এবং হাঁসুয়াটি ব্যাগে ভরে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। কেউ যাতে সন্দেহ না করে ওই রাতে সেও তার মামার ফোনে কল দিয়েছিল। তিনি আরও জানান, এরপর দুই দিনেও যখন স্বজনরা বিকাশ, তার স্ত্রী স্বর্ণা ও মেয়ে তুষির খোঁজ পায় না ও মোবাইলও রিসিভ হয় না তখন বিকাশ সরকারের আরেক ভাগ্নে লিপু বগুড়ার শেরপুর থেকে তাড়াশে আসেন এবং হত্যাকারী রাজিবকে সঙ্গে নিয়ে তার মামার বাড়িতে যায় এবং তালাবদ্ধ দেখে পুনরায় কল করে দেখে ঘরে ফোনের আওয়াজ শোনা যায়। এতে তাদের সন্দেহ হলে পুলিশকে খবর দেয়। তালাবদ্ধ দেখে অন্য স্বজনদের সঙ্গে রাজিবও তাড়াশ থানায় যায় এবং পুলিশকে সঙ্গে এনে দরজা ভাঙে। রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত আসামি রাজিব স্বজনদের সঙ্গেই ছিল। পুলিশ সুপার বলেন, অডিও শোনার পরই বিকালে রাজিবকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক পুকুর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রড এবং তার বাড়ি থেকে রক্ত মাখা হাঁসুয়া উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিকাশ সরকারের স্ত্রীর ভাই সুকোমল চন্দ্র সাহা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। পুলিশ সুপার কার্যালয়ের হলরমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সংবাদ কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

নিহত বিকাশ সরকারের মা শান্তি বেলা ও ভাগ্নে লিপুন বলেন, হত্যাকারী যেই হোক না কেন তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে। জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সন্তোষ কুমার বলেন, জাতি-গোষ্ঠী ভেদাভেদ না করে হত্যাকারীকে হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর