বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

সব অপরাধেই কিশোর গ্যাং

সারা দেশে পাঁচ শতাধিক, শীর্ষে ৮২, ঢাকায় ৫২

সাখাওয়াত কাওসার

সব অপরাধেই কিশোর গ্যাং

গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ৭টা। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ এলাকা। ‘ইমারজেন্সি সাইরেন’ বাজিয়ে মহড়া দিচ্ছিল প্রায় ১৫টার মতো মোটরসাইকেলে। প্রতিটি  মোটরসাইকেলে ছিল দুই থেকে তিনজন করে কিশোর। তাদের হাতে ছিল রাম দা, হকিস্টিক, লাঠিসহ দেশি অস্ত্র। তবে হঠাৎ করেই ওই মহড়া থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। একটি গুলি গিয়ে লাগে সৌদি প্রবাসী মাহবুব আলমের ফ্ল্যাটে। গুলির আঘাতে ছিদ্র হয় জানালার কাচ। আরেকটি গুলি বিদ্ধ হয় একই এলাকার কলেজশিক্ষক শিমুল খন্দকার নামের এক ব্যক্তির ভাড়া বাসার জানালায়। শুধু তাই নয়, এ ঘটনার কেবল এক দিন আগেই এমন আরেকটি মহড়া থেকে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, মাঝে মাঝেই এরা এলাকায় মহড়া দিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে আসছিল অনেক দিন ধরে। তবে পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে আসছিল।

গতকাল শ্রীপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছিলেন, নির্বাচনের সময় আমি এ থানায় এসেছি। তাই অনেক কিছুই আমার কাছে অজানা। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ছয়জনকে অজ্ঞাত উল্লেখ করে মামলা হয়েছে।

গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন মগবাজারের মধুবাগ এলাকায় খুন হয় কিশোর আশিক মিয়া (১৪)। ব্যাডমিন্টন খেলাকে কেন্দ্র করে আশিক খুন হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের মা শাহনাজ বেগম। তিনি বলছেন, হত্যাকাণ্ডে এলাকার বখাটে মইনুদ্দিন, তানভীর, জাহাঙ্গীর, বেলাল, রাসেলসহ অন্তত ১১ জন জড়িত। এই কিশোর গ্যাংয়ের কারণে মধুবাগসহ আশপাশের এলাকায় অনেকেই অতিষ্ঠ। পুলিশ বলছে, যাদের নাম এসেছে তাদের প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। এদের কয়েকজন আগেও বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিল। তবে বয়স কম হওয়ার কারণে তারা দ্রুতই জামিন পেয়ে বাইরে এসে আগের মতোই অপরাধ কান্ডে জড়িয়েছে।

এ তো গেল মাত্র দুটি ঘটনা। তবে হরহামেশাই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে গ্যাং কালচার। কিশোর অপরাধীরা ঘটিয়ে চলছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভটিজিংসহ হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেম নিয়ে বিরোধ, মাদকদ্রব্যসহ নানা অপরাধে অনেক কিশোর-তরুণ নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য শুরুর দিকে কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলেও এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ায় রীতিমতো চ্যালেঞ্জে পড়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকগুলো প্রভাবক জড়িত থাকার কারণে ‘গ্যাং কালচার’-এর নিয়ন্ত্রণ আনতে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছেন কর্তৃপক্ষ। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় নানাভাবে এর সুযোগ নিচ্ছে কিশোর অপরাধীরা। তবে কোমলমতি এসব কিশোরকে ব্যবহার করে ফসল ঘরে তুলছে ‘গ্যাং’-এর পৃষ্টপোষকরা। একাধিক সংস্থার তালিকায় দেখা গেছে, সারা দেশে অন্তত ৫ শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকে এলিট ফোর্স র‌্যাবের তালিকায় রাখা হয়েছে ৮২টি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীতে ৫২টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের অধীন ৩৫ থানা এলাকায় এসব চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬৯২। ডিএমপির তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে উত্তরা এলাকায় ছয়টি চক্রে ৬৪ জনের মতো সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ‘ডিসকো বয়েজ’ ‘ইয়াংস্টার গ্রুপ’ ‘বিগবস’, ‘নাইন স্টার গ্রুপ’ ইত্যাদি নামে এসব অপরাধীচক্র রয়েছে। ডিএমপির মিরপুর পুলিশের তালিকা অনুসারে, মিরপুর এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং সাতটি চক্র রয়েছে পল্লবী থানা এলাকায়। এর মধ্যে ‘আশিক গ্রুপ’ অন্যতম। এই চক্রে ২৫ জনের মতো সদস্য। মিরপুর এলাকায় রাজু গ্রুপ, রকি গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ, মুসা গ্রুপ ও সোহেল গ্রুপের তৎপরতা বেশি। একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি প্রথমে আলোচনায় আসে। পরে উত্তরা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় স্কুলছাত্র শুভসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। কিশোর গ্যাংয়ের অপসংস্কৃতি রোধে অসংখ্য আসামিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তবে কিশোর গ্যাং সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ঢাকায়। পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অপরাধীচক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। বেশির ভাগ থাকে বস্তি এলাকায়। তবে সঙ্গদোষে অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং মিরপুর বিভাগে। এই বিভাগে ১৩টি কিশোর অপরাধীচক্রের ১৭২ জন সক্রিয় বলে পুলিশের তালিকায় উল্লেখ রয়েছে। তেজগাঁও ও উত্তরায়ও কিশোর গ্যাং তৎপর। পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্যরা সব সময় আইনের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। আইনের চোখে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তারা দ্রুতই জামিনে বের হয়ে আসছে। শুধু পুলিশ চাইলেই এর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মদদ রয়েছে। এলাকায় নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে তারা কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্টপোষকতা করছেন। তাদের কারণেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যরাও অনেক সময় চুপসে যাচ্ছেন। গ্যাংয়ের সদস্যরা সড়কে উচ্চশব্দে গান বাজানো, বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, পথচারী ও কিশোরী-তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা এবং তুচ্ছ ঘটনায় সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হচ্ছে। এক বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে অন্তত ২৫ জন খুন হয়েছেন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে পারিবারিক ও সামাজিক উদ্যোগ দরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। তবে শুধু পুলিশি তৎপরতায় এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব কিশোর গ্যাং নিয়ে শুরু থেকেই কাজ করে আসছে। এখন আমরা গ্যাংগুলোর পৃষ্টপোষকদের শনাক্ত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। মদদদাতারা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন, যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার কাজে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। র‌্যাব সদর দফতর সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে র‌্যাবের অভিযানে সারা দেশ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রুপের ৩৪৯ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের ১ হাজার ১২৬ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার মধ্যে ৪০ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে র‌্যাব। এ ছাড়া ৩০ জনকে অর্থদণ্ড ও ১০ জনকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সাম্প্রতিক যত ঘটনা : গত ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালী সদর উপজেলার বাঁধেরহাট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সৌরভ হোসেন ওরফে সাজ্জাদ (২০) নামে এক প্রবাসীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় পথচারী রাকিবসহ আরও পাঁচজন গুরুতর আহত হন।  গত বছর ২২ মে রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুঠি এলাকার বসুপাড়ায় স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার আগে ১০ মে দনিয়া কলেজের সামনে ‘জুনিয়র-সিনিয়র’ দ্বন্দ্বে খুন হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তাজুন ইসলাম ওরফে মুশফিক। পুলিশ জানায়, দুটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে এলাকাভিত্তিক কিশোর অপরাধী চক্র জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত বছরের ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর আদাবর থেকে ‘বিডিএসকে গ্যাং’ গ্রুপের প্রধান হৃদয় ওরফে হিটার হৃদয়সহ আট সদস্য এবং পরদিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, শ্যামপুর ও কদমতলী এলাকা থেকে কিশোর গ্যাং লিডার জালাল ওরফে পিচ্চি জালাল বাহিনীর ১৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ ছাড়া ৬ ফেব্রুয়ারি আদাবর, মোহাম্মদপুর ও হাজারীবাগ এলাকা থেকে ২০ সদস্য; ২২ মার্চ মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, শেরেবাংলা নগর ও তেজগাঁও এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের ৪৩ সদস্য; ২৮ এপ্রিল আশুলিয়ার নবারটেক এলাকা থেকে লিখন হত্যার আসামি কিশোর গ্যাং সদস্য অনিক ও জোবায়েরকে র‌্যাব গ্রেফতার করে। এ ছাড়া ২৬ মে দারুসসালাম, সাভার ও বরিশালের বাকেরগঞ্জের সিয়াম হত্যা মামলার প্রধান আসামি কিশোর গ্যাং লিডার পটেটো রুবেল ও তার সহযোগী রকি, ১৬ জুন ফেনীর রামপুর থেকে নুরু গ্যাংয়ের প্রধান মাহিদুল ইসলাম সুজনসহ তিনজন, ১৬ জুলাই বনানী থেকে পিচ্চি জয় গ্রুপের তিনজন, ৮ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর ও বাগেরহাট থেকে কবজি কাটা গ্রুপের আনোয়ার, সদস্য মো. রাফাত, তুষার, আহমেদসহ সাতজন, ২৮ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান থেকে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর