রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঢাকায় কেন লক্কড়ঝক্কড় বাস

♦ ভিতরে নোংরা, দুর্গন্ধের মধ্যে চলছে যাত্রী পরিবহন ♦ হেডলাইট, দরজা, জানালার গ্লাস, সিট ভাঙা ♦ সড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি ৫ লাখ ৭৭ হাজার

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও হাসান ইমন

ঢাকায় কেন লক্কড়ঝক্কড় বাস

রাজধানীতে এরকম লক্কড়ঝক্কড় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে অবাধে -জয়ীতা রায়

যাত্রাবাড়ী থেকে মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা হয়ে টঙ্গী রুটে চলাচল করে তুরাগ পরিবহন। রামপুরা ব্রিজে যাত্রী তোলার জন্য দাঁড়ানো তুরাগ পরিবহনের বাসে দেখা যায় এর পেছনের অংশে কোনো বাতি নেই। বাসের রং কোথাও উঠে গেছে, কোথাও মরিচা ধরা, অসংখ্য ফুটো, কোথাওবা পোস্টার সাঁটানো। পেছনের অংশের মতো সামনের দিকেও বাসের রং চটা, চারটির মধ্যে একটি হেডলাইট নেই। নেই কোনো দিকনির্দেশক বাতি। রাজধানীজুড়ে চলছে ভাঙাচোরা, লক্কড়ঝক্কড় বাসের দৌরাত্ম্য। কোনোটির রং চটা, কোনোটির ছাল ওঠা। কোনোটির জানালার গ্লাস ভাঙা, কোনোটির আবার দরজাই নেই। কিছু বাসের আসনগুলোরও করুণ অবস্থা। বাসের ভাঙা সিটে অনেক সময় যাত্রীদের জামাকাপড় ছিঁড়ে গিয়ে লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেক বাসের ভিতরে প্রস্রাবের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, সিটে বাসা বেঁধেছে ছারপোকা। ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহনে চলাচল যেমন বিপজ্জনক তেমনি নগরীর সৌন্দর্যহানিও করছে। বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল করায় হচ্ছে যানজট।

সরকারের নীতিমালা না থাকায় এ সুযোগ নিচ্ছেন বাস মালিকরা। দুই দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় রুট অনুযায়ী গণপরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট রং নির্ধারণ করত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বাসের রং উঠে গেলে সেটি চলাচলের অনুপযোগী হবে। বিআরটিএর সেই সার্কুলার পরবর্তী সময়ে নতুন করে জারি করা হয়নি। বর্তমানে রাজধানীর ২৯১টি রুটে চলাচলকারী ৪০ হাজার বাসের অধিকাংশই এখন রংচটা অবস্থায় চলছে।

গত তিন দিন রাজধানীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর এবং গাবতলী রুটে সরেজমিনে এমনই দৃশ্য চোখে পড়েছে। লোকাল সার্ভিস, সিটিং সার্ভিস এমনকি টিকিট সার্ভিসের গাড়িতেও একই অবস্থা। গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী ও সদরঘাট রুটে চলাচলকারী ‘৮ ও ৭ নম্বর’ এর অধিকাংশ বাসেই দেখা যায়, কোনোটির গ্লাস ভাঙা, কোনোটির লুকিং গ্লাসই নেই, কোনোটির সামনে ও পেছনের বাম্পার খোলা। কোনোটির জানালার কাচ অর্ধভাঙা হয়ে ঝুলছে, কোনো কোনোটির আবার বডি দুমড়ানো-মুচড়ানো। আবার কোনো কোনো গাড়ি ভাঙাচোরা না হলেও রাস্তায় চলাচলের সময় অন্য গাড়ির সঙ্গে ঘষাঘষির কারণে দুই তিন মাসের মধ্যেই রং উঠে কদাকার। রাজধানীর মৌচাক মোড়ে যানজটে আটকে থাকা এরকম একাধিক বাস চোখে দেখা যায়।

বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে মোট পরিবহন নিবন্ধিত হয়েছে ২০ লাখ ৮১ হাজার ২৬০টি। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবহনের সংখ্যা ৫ লাখ ৭৭ হাজার ১টি। রাজধানীতে বাসের সংখ্যা ৪১ হাজার ৪৬২টি। যার মধ্যে ২১ হাজার ৪৪৫টি বাসের ফিটনেস নেই। এ ছাড়া ১১ হাজার ৪৬৩টি মিনিবাস, অ্যাম্বুলেন্স ৩ হাজার ৯৫, অটোরিকশা ১ লাখ ৯৪ হাজার ১৪৭, অটোটেম্পো ৫ হাজার ৪৮৩, প্রাইভেট কার ৬১ হাজার ৮২৯, কার্গোভ্যান ১ হাজার ৮৪১, কাভার্ড ভ্যান ৭ হাজার ৮৮০, জিপ ১৩ হাজার ৮২৮, মাইক্রোবাস ২৬ হাজার ৮৭০, পিকআপ ৬৮ হাজার ৪৭৭ ও টেক্সিক্যাব ৬ হাজার ৮৫৪টির ফিটনেস নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকা মহানগরীতে চলমান বাস-মিনিবাসের মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশের দরজা-জানালা ভাঙা। বসার সিট ছিঁড়া। ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসের সিটে দুই স্তরের কাঠামো (স্টিল ও ফোম/কাপড়) নেই। আর যেসব বাসে স্টিলের কাঠামোর ভিতর ফোম বা কাপড়ের স্তর রয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশও ছিঁড়া। তাছাড়া রাজধানীর অধিকাংশ বাসের পেছনের সিগন্যালিং লাইটগুলো অকেজো। কিছু কিছু বাস-মিনিবাসে পাখা থাকলেও বেশির ভাগই নষ্ট থাকে। রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় ৫০ হাজার বাস-মিনিবাসের মধ্যে অর্ধেকের বেশির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (২০ বছর) পেরিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে রাজধানীতে চলাচলকারী ৬৫ শতাংশ বাস-মিনিবাসই ফিটনেসবিহীন। ২০১০ সালে রাজধানীতে ২০ বছরের অধিক পুরনো বাস-মিনিবাস চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময় একবার অভিযান চালানো হলে অনেকেই পুরনো বাস-মিনিবাস বন্ধ করে রাখেন। কিন্তু অভিযান শেষে আবারও পুরনো, ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস নামানো হয়।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীতে লক্কড়ঝক্কড়, মেয়াদোত্তীর্ণ ও রংচটা বাস বিআরটিএ-এর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব বাস বন্ধে শুধু বিআরটিএ নয়, পরিবহন মালিকদের সদিচ্ছা লাগবে। তাহলে সম্ভব রাজধানীর সড়ক থেকে লক্কড়ঝক্কড় বাস ওঠানো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জরিমানা না হওয়ায় বেপরোয়া গতিতে চালকরা প্রতিযোগিতা করে রাস্তায় বাস চালাচ্ছেন। এর শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন, কেউবা চিরকালের মতো পঙ্গু হচ্ছেন। আমিনবাজার থেকে মিরপুর, কাকলী, নতুন বাজার হয়ে ডেমরা রুটে চলাচল করে ‘অছিম পরিবহন’। গতকাল নতুন বাজার স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো এক বাসে দেখা যায় স্টপেজসহ সব লেখা, রং মুছে গেছে। এর সঙ্গে রংচটা, দিকনির্দেশক বাতি নেই, ব্যাক লাইট ভাঙা তো আছেই। তবে বাস থেকে বের হয়ে হাসিমুখে কথা বলতে থাকেন চালক মো. সুমন। বাসের করুণ দশার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এ বাসের বয়স দুই বছর। পাল্লাপাল্লি কইরা চলতে হয়। অন্য বাসে ধাক্কা মারে। হুড়োহুড়িতে রং ঠিক থাকে না। মালিকে জরিমানা করে। কিন্তু রং করে না।’

সবচেয়ে করুণ অবস্থা দেখা মেলে রবরব পরিবহনের বাসের। এদের বাসগুলো গাবতলী থেকে মিরপুর, কালশী, মাটিকাটা হয়ে রাজধানীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশান ঘুরে যায় নতুন বাজার পর্যন্ত। এ বাসে নেই ডিজিটাল নম্বর প্লেট। কাচ, জানালা ভাঙা, রংচটা। ব্যাক লাইট নেই। ভিতরে সিটগুলো ভাঙা। অনেকগুলোর সিটের ওপরের ফোম উঠে গেছে।

আবদুল্লাহপুর, নতুন বাজার, পল্টন, সদরঘাট রুটে চলাচল করে ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহন। এ গাড়িতে নিয়মিত খিলক্ষেত থেকে পল্টন যাতায়াত করেন ফরহাদ হোসেন। পল্টনে কার্ডের দোকান রয়েছে তার। তিনি বলেন, বাসগুলোর অধিকাংশের রং উঠে গেছে, বিভিন্ন জায়গায় জোড়াতালি দেওয়া। বাসের ভিতরে নোংরা, অনেক সময় প্রস্রাবের দুর্গন্ধ নাকে লাগে। সিটে বাসা বেঁধেছে ছারপোকাও। বাড্ডায় বাস থেকে নামতে গিয়ে সিটের ভাঙা অংশে লেগে বোরকা ছিঁড়ে যায় এক নারীর। এ নিয়ে যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বাসের সুপারভাইজারের ওপর।

সর্বশেষ খবর