রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
পোশাক কারখানা

নারী শ্রমিকদের সমস্যার শেষ নেই

রাশেদ হোসাইন

নারী শ্রমিকদের সমস্যার শেষ নেই

পোশাকশিল্পের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের ৬০ শতাংশ নারী। নারী পোশাক শ্রমিকদের সমস্যার শেষ নেই। কর্মক্ষেত্রে বেতন বৈষম্য, মাতৃত্বকালীন ছুটির সমস্যা, যৌন হয়রানির শিকার, তুলনামূলক বেশি কর্মঘণ্টা, শারীরিক ও মানসিক সমস্যাসহ অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। রাজধানীর কয়েকটি গার্মেন্টস ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

রাজধানীর মাতুয়াইলের একটি পোশাক কারখানায় হেলপার হিসেবে কাজ করেন কুলসুম বেগম। নেশাগ্রস্ত বেকার স্বামী মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লেবারের কাজ করেন। স্বামীর আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। এজন্য তিন সন্তানের ভরণপোষণের ভার তার একার কাঁধে রয়েছে। এ কারণে সাত বছর ধরে এখানে কাজ করেন তিনি। ভোরবেলা উঠে ঘরের কাজ আর রান্নাবান্না শেষ করে ৮টায় কারখানায় যাওয়া লাগে। ফিরতে ফিরতে রাত ৯টার মতো বেজে যায়। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। মাস শেষে বেতন পান ৭ হাজার টাকা। একই সময় একই ধরনের কাজ করেন তার পুরুষ সহকর্মীরা। পুরুষ সহকর্মী হেলপারের বেতন ৯ হাজার টাকা। আবার কেউ কেউ ১০ হাজার টাকাও পান। মাঝে-মধ্যে ওভারটাইম কাজ করা লাগে তার। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর যে টাকা আয় হয় তাতে ঘরভাড়া দেওয়ার পরই খাবার কেনার টাকায় টান পড়ে যায় তার। কাজ করতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় বলে জানান কুলসুম। রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকার আরেক নারী শ্রমিক আফসানা। মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করেন একটি পোশাক কারখানায়। বাবা কৃষিকাজ করেন। মা বাসায় অসুস্থ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় আফসানা। পরিবারে টানাটানির কারণে অল্প বয়সেই পোশাক কারখানায় কাজ করতে আসতে হয়েছে বলে জানান আফসানা। তিনি বলেন, বাসা ভাড়া বেশি হওয়ায় বেতনের অর্ধেক চলে যায় ভাড়ায়। বাকি টাকা দিয়ে অন্যান্য খরচ চলে না। স্বাস্থ্য-চিকিৎসার জন্য কোনো টাকা থাকে না। পরিবার চালাতেই হিমশিম অবস্থা, অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য ধার করতে হয়। শুধু কুলসুম কিংবা আফসানা নয়, বাংলাদেশে প্রায় অধিকাংশ নারী গার্মেন্টস কর্মীর প্রাত্যহিক গল্প অনেকটা এরকমই। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গত বছরের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে অঞ্চলভেদে নারী পোশাক শ্রমিকদের মজুরিতে ৫১ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ ফারাক রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ওভারটাইম বাদে শ্রমিকদের মাসিক গড় আয় ছিল ৯ হাজার ৯৮৪ টাকা। এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের বেতন ছিল যথাক্রমে ৯ হাজার ৬৬৯ টাকা ও ১০ হাজার ৯২৮ টাকা। পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের ওপর চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণা করছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। তাদের গবেষণা বলছে, পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। কয়েক বছর আগের এ গবেষণায় আইসিডিডিআর-বি দেখিয়েছে, ১৮-৪৯ বছর বয়সী ওই নারী শ্রমিকদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে আটজনই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। তাদের গবেষণার ফল বলছে, শুধু রক্তস্বল্পতাই নয়, অপুষ্টিজনিত নানা শারীরিক জটিলতায়ও ভুগছেন নারী পোশাক শ্রমিকরা।

কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করায় এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিষণ্নতাসহ শারীরিক-মানসিক নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতে উৎপাদনশীলতায় প্রভাব পড়ে। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহীন আলম বলেন, নারীদের ক্ষেত্রে প্রধানত যে সমস্যা হয় তা হলো, বেতন বৈষম্য, পুরুষের চেয়ে নারীদের কম বেতনে কাজ করানো যায়। এ কারণে অনেক জায়গায় পুরুষ শ্রমিকদের নিতে চায় না। এ ছাড়া নারী শ্রমিকদের বেশি করে ওভারটাইম করানো যায়। অনেক সময় তাদের বের হতে রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বেজে যায়। এ কারণে তাদের রাস্তায় হয়রানির শিকার হতে হয়। তারা পরিবারকে ঠিকমতো সময় দিতে পারে না। তাদের সন্তানরা সমাজের অন্য দশটা ছেলেমেয়ের মতো বেড়ে উঠতে পারে না। তিনি বলেন, নারী শ্রমিকরা শ্রম আইন বিষয়েও তেমন কিছু জানে না। কারখানা থেকে তাদের এ বিষয়ে কোনো ধারণাই দেওয়া হয় না। ট্রেড ইউনিয়নগুলোও শ্রম আইন বিষয়ে ধারণা দিতে পারে না। এর কারণ হলো, নারীদের অফিস থেকে বের হয়ে পরিবারকে সময় দিতে হয়। আমাদের দেশে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। যা নারী শ্রমিকদের শোষণের একটা মাধ্যম বা বড় হাতিয়ার বলা যায়।

সর্বশেষ খবর