শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
ঢাকার ফ্লাইওভার

ওপরে ফিটফাট নিচে সদরঘাট

জায়গা দখল করে রমরমা ব্যবসা, চায়ের দোকান থেকে পাইকারি বাজার সবই বসছে, বেচাকেনা হচ্ছে মাদক, ছিনতাইকারী-মাদকসেবীদের নিরাপদ আশ্রয়, মলমূত্র ও আবর্জনার ভাগাড়

শামীম আহমেদ

ওপরে ফিটফাট নিচে সদরঘাট

একের পর এক ফ্লাইওভার, ইউলুপ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল যানজট কমানোর পাশাপাশি শোভা বাড়িয়েছে রাজধানীর। পাখির চোখে দেখলে এসব স্থাপনার কারণে ঢাকাকে অনেকটা ইউরোপ-আমেরিকার মতো মনে হলেও ঠিক বিপরীত চিত্র চোখে পড়ে ফ্লাইওভারগুলোর নিচে। পাবলিক টয়লেটের অভাবে থাকা নগরবাসী প্রাকৃতিক কর্ম সারছেন ফ্লাইওভারের নিচে। প্রস্রাব গড়িয়ে পড়ছে মূল সড়কে। আশপাশের সব দোকান ও সড়কের আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে সেখানে। এসব স্থাপনার নিচের জায়গা দখল করে গাড়ি পার্কিং ও দোকান বসিয়ে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বসছে হাঁস-মুরগি, মাছের পাইকারি বাজার, ভাঙারির দোকান। সন্ধ্যা নামলেই ফ্লাইওভারগুলোর নিচে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা যৌনকর্মী ও ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে। জমে উঠছে মাদক বেচাকেনা।

গত এক সপ্তাহে দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর সাতটি ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল ও কয়েকটি ইউলুপ ঘুরে এমন চিত্র সামনে এসেছে। রাতে ফ্লাইওভারগুলোর ওপরে দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতির নিচ দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে গাড়ি, নিচে অন্ধকারে চলছে নানা অপকর্ম। এ যেন ওপরে ফিটফাট, নিচে ‘সদরঘাট’! দখল হয়ে গেছে অধিকাংশ ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাগুলো। পাইকারি বাজার, গাড়ি পার্কিং, অস্থায়ী দোকান, ভাতের হোটেল, টেম্পো স্ট্যান্ড বসিয়ে আদায় করা হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, থানা পুলিশ, সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে কর্মচারীরা এই চাঁদাবাজিতে জড়িত। এ কারণে ফ্লাইওভারগুলোর নিচের সুপরিসর জায়গাগুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নগরবাসীর উপকারে আসে এমন কোনো কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়নি।

এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, নিরাপদে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা গেলে ফ্লাইওভারের নিচে গণশৌচাগার, মানুষের বসার স্থান বা পার্কের মতো কিছু করা যায়। নাগরিকদের কাজে লাগে, এমন কিছু করা যায়। পরিকল্পিতভাবে এটাকে সিটি করপোরেশনের আয়ের উৎসও বানানো সম্ভব। নানাভাবে সৌন্দর্যবর্ধন করা যেতে পারে। কিন্তু জায়গা ফেলে রাখলে দখলও হবে, নানা অপরাধও এখানে হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে মগবাজার ও মহাখালী ফ্লাইওভারের পিলারে স্ট্রিট আর্ট করে দিয়েছি। ফ্লাইওভারের নিচের খালি জায়গায় সৌন্দর্য বর্ধনসহ খেলার ব্যবস্থা করে দেব। কুড়িলে এক্সপ্রেসওয়ের নিচে খেলাধুলার জন্য এবং গণপরিসর করার জন্য ডিজাইনের কাজ চলছে। দ্রুতই বাস্তবায়ন করা হবে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের পুরো জায়গাকে সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য সাড়ে ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ফ্লাইওভারকে ৮টি অংশে ভাগ করে ১-৩ অংশের নকশা প্রণয়ন হয়ে গেছে। দরপত্র মূল্যায়ন চলছে। চতুর্থ অংশের নকশা প্রণয়ন হয়েছে, ৫-৮ অংশের নকশা প্রণয়নের কার্যক্রম চলছে। এই কার্যক্রম সম্পন্ন হলে আর কোনো অবৈধ দখল থাকবে না। এর মধ্যে পার্কিং, বসার জায়গা, বৃক্ষরোপণসহ অনেক কিছু থাকবে। সরেজমিন গত বুধবার কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচে গিয়ে দেখা যায় এখানে জনস্বার্থে একটি পাবলিক টয়লেট তৈরি করা হয়েছে। বাকি জায়গাতে বসেছে প্রায় ৭০টি অস্থায়ী দোকান। দোকানদাররা জানান, একটি চায়ের দোকানের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের দৈনিক ২০০ টাকা, পুলিশকে ১০০ টাকা ও বিদ্যুতের জন্য ২০ টাকা দিতে হয়। নেতাদের ভাগের টাকা সন্ধ্যায় লাইনম্যান এসে নিয়ে যায়। বিদ্যুতের জন্য সিটি করপোরেশনের কর্মীরা টাকা নেয়। সেখানে দেখা যায় পাবলিক টয়লেট থেকে বিদ্যুতের লাইন টেনে প্রতিটা দোকানে ঝুলন্ত সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বাড্ডা ইউলুপের নিচে প্রায় ৪০ ফুট চওড়া ও ২০০ ফুট লম্বা সুপরিসর জায়গাজুড়ে করা হয়েছে নার্সারি। নার্সারিটি জায়গার সৌন্দর্য বাড়ালেও এখান থেকে সরকার কানাকড়িও পাচ্ছে না। নার্সারির সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে সোনারগাঁও নার্সারি ও উদয়ন নার্সারি। রাজউক থেকে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর জায়গাটি বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। জায়গাটি কত টাকা দিয়ে কত দিনের জন্য বরাদ্দ নেওয়া- এমন প্রশ্নে নার্সারির পরিচালক হারুন অর রশিদ বলেন, মাসে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু হাতিরঝিলের রেস্টুরেন্ট নিয়ে বেলার একটি রিট রয়েছে। এ কারণে টাকা দেওয়া বন্ধ আছে। কখনো টাকা দিয়েছিলেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বরাদ্দ নেওয়ার পর ময়লার স্তূপ পরিষ্কার করেছি, পানি-বিদ্যুৎ আনতেই ২-৩ বছর লেগেছে। রিটের কারণে টাকা দেওয়ার সুযোগ হয়নি। মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচটা পরিণত হয়েছে আবর্জনার স্তূপে। আশপাশের সব দোকানের আবর্জনা ফেলা হয় ফ্লাইওভারের নিচে। অনেক স্থানে ৪ ফুট উঁচু আবর্জনা জমেছে। এ ছাড়া রয়েছে রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ, গাড়ি পার্কিং, চায়ের দোকান। অনেক স্থানে মানুষের মল-মূত্র দেখা গেছে। মালিবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে হয়েছে ভাঙারির দোকান। এফডিসি অংশে প্রতিদিন ভোরে বসছে মাছের পাইকারি আড়ত। সেখানে ফুট হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয় জায়গা। তবে এই টাকার কানাকড়িও সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে না। গত সোমবার রাত ৯টার দিকে ফ্লাইওভারের সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের অংশে বিভিন্ন স্থানে অন্ধকারে চার-পাঁচজন করে কিশোর-কিশোরীকে জটলা করতে দেখা যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কিশোর-কিশোরীগুলো আশপাশের বস্তিতে থাকে। সন্ধ্যার পর কখনো ফ্লাইওভারের নিচে, কখনো রেললাইনের পাশে গাঁজা-ইয়াবা বিক্রি করে। এরা দলবেঁধে ছিনতাইও করে। অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষকে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে দেখা যায়। হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে ভাত, কাপড়, জুতাসহ অসংখ্য অস্থায়ী দোকান দেখা গেছে। তবে দিনের বেলায় দোকানপাট কম থাকলেও রাত ১২টার পর বাজার জমে ওঠে বলে জানান স্থানীয়রা। জয়কালী মন্দির থেকে নবাবপুর পর্যন্ত মাঝ রাত থেকে ভোর পর্যন্ত জমে ওঠে হাঁস-মুরগির ব্যবসা। রাস্তায় টেবিল বসিয়ে হাঁস-মুরগি বহনকারী প্রতিটা পিকআপ থেকে তোলা হয় চাঁদা। ভোরে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে কাজলা পর্যন্ত ফ্লাইওভারের উভয় পাশে জমে ওঠে পাইকারি ও খুচরা মাছের ব্যবসা। পুরো সড়কে যানজট লেগে যায়। এই মাছের বাজার থেকে দৈনিক দেড়-দুই লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় বলে জানা গেছে। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচেও দেখা গেছে অনেক দোকানপাট।

 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর