শনিবার, ২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
সরেজমিন

আলো ঝলমলে সেই ভবন এখন অঙ্গার

মাহবুব মমতাজী

আলো ঝলমলে সেই ভবন এখন অঙ্গার

আগুনে পুড়ছে বেইলি রোডের ছয় তলা ভবন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এমন সকাল হয়তো কখনো দেখেননি রাজধানীর বেইলি রোডের বাসিন্দারা। অন্য দিনের মতো ছিল না সাধারণ কোনো গাড়ি। একটু পর পর আসছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, টহল দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নেই গাড়ির হর্ন কিংবা রিকশার বড় জটলা। যদিও সাধারণ মানুষের ভিড় ছিল একটু বেশিই। একটি ভবন ঘিরেই এমন দৃশ্যের পরিবর্তন।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ভবনটি আলো ঝলমল করে ওঠে। এটি রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কজি কটেজ’। সাত তলা ভবনটিতে কাচ্চি ভাইসহ ছয়টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কাচ্চি ভাইয়ের খাবারের সুনামে ভোজনপ্রেমীদের ভিড় লেগেই থাকে সেখানে। এ ছাড়াও নামিদামি সব রেস্টুরেন্টের বিশেষ গ্রাহকও ছিল। সব মিলিয়ে সন্ধ্যার পর জমজমাট আড্ডার আসর জমে ভবনটিতে। অধিবর্ষ বা লিপইয়ার উদযাপনে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে এখানে আসতে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। গ্রিন কজি কটেজ পরিণত হয় উৎসবস্থলে।

তবে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে ১০টায় ভবনটির নিচতলায় একটি খাবারের দোকানে লাগা আগুনে মাত্র দুই ঘণ্টায় পুড়ে ছাই হয়েছে পুরো ভবন। অকালে ঝরে গেছে ৪৬ প্রাণ। আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন দগ্ধরা। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদের কেউ ভবনটির রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন পরিবারসহ, কেউ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। কেউ কেউ ভবনটিতে কাজ করে সংসার চালাতেন। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনটিতে নিচতলায় ‘স্যামসাং’ ও ‘গেজেট অ্যান্ড গিয়ার’ নামে দুটি ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকান এবং ‘শেখলিক’ নামে একটি জুসবার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ছিল। দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামে একটি রেস্তোরাঁ, তৃতীয় তলায় ‘ইলিয়ন’ নামে একটি পোশাকের দোকান, চতুর্থ তলায় ‘খানাস’ ও ‘ফুকো’ নামে দুটি রেস্তোরাঁ, পঞ্চম তলায় ‘পিৎজা ইন’ নামে একটি রেস্তোরাঁ, ষষ্ঠ তলায় ‘জেসটি’ ও ‘স্ট্রিট ওভেন’ নামে দুটি রেস্তোরাঁ এবং ছাদের একাংশে ‘অ্যামব্রোশিয়া’ ও ‘হাক্কা ঝাক্কা’ নামে দুটি রেস্তোরাঁ ছিল। তৃতীয় তলার ‘ইলিয়ন’ নামের পোশাকের শোরুম, আর ছাদের একাংশে থাকা রেস্তোরাঁ ছাড়া সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

গতকাল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পথচারীরা যে যার মতো পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। যাওয়ার সময় একটু দাঁড়িয়ে দেখছেন পুড়ে যাওয়া ভবনটি। একজন অন্যজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইছিলেন আগুন লাগার ঘটনা। এই উৎসুক জনতার ভিড় শুরু হয় সকাল থেকেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পুড়ে যাওয়া স্থানে সকাল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং কাউন্টার টেররিজম এবং ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সদস্যরা। দুলাল নামে এক পথচারী বলেন, রাতে আসিনি এখন এলাম। অনেক মানুষ মারা গেছে তাই ঘটনাস্থলটি দেখতে এলাম।

পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান জানান, এখানে আগুন লাগার কয়েকটি কারণের মধ্যে সিলিন্ডার কিংবা গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। আগুনের চেয়ে শ্বাসরোধে বেশি হতাহত হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করছি, এগুলো ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে। পরে জানা যাবে আগুন লাগার কারণ। ফেব্রুয়ারির শেষ দিন অর্থাৎ লিপইয়ার ঘিরে খাবারের দোকানগুলোতে চলছিল ধামাকা অফার। তাই অফার গ্রহণে মানুষের উপস্থিতিও ছিল অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। স্থানীয় বাসিন্দা ও আশপাশের দোকান কর্মীরা জানান, খাবার দোকান থাকায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পরই ভিড় হতো ভবনটিতে। বৃহস্পতিবার অধিবর্ষ উপলক্ষে ৫০ শতাংশ ছাড় দেয় ‘কাচ্চি ভাই’। এ ছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন থাকায় ভিড় ছিল সাধারণ দিনের চেয়ে বেশি।

পাশের ভবনের নিরাপত্তা কর্মী শরিফ বলেন, প্রতিদিনই ভিড় হয়। সবাই খাওয়াদাওয়া করতে আসে। বৃহস্পতিবার ভিড় বেশি ছিল। রাত ১০টায় গিয়ে দেখি নিচতলায় একটা দোকানে আগুন ধরেছে। এরপর তো পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এদিকে বেইলি রোড মানেই বাহারি খাবারদাবারের আয়োজন। এর স্বাদ নিতে লোকজন ছুটে আসেন রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর গতকাল সকাল থেকেই বেইলি রোডের খাবার হোটেল ও দোকানগুলো খোলা ছিল। তবে নেই ক্রেতার কিংবা হোটেল কর্মচারীদের হাঁকডাক। পুরো বেইলি রোডেই যেন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বেইলি রোডের সুইস, এ ওয়ান, আল খাব্বাজ, আল এরাবিয়া, হট কেক, মিনি সো, প্যারাডাইস ফ্রুট জুসবার, কফি লাইনসহ আরও কয়েকটি খাবার দোকান খোলা দেখা যায়। যেখানে হাতেগোনা কয়েকজন ক্রেতার দেখা মেলে।

 

সর্বশেষ খবর