শনিবার, ২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

মৃত্যুঝুঁকি বাণিজ্যিক ভবনে

♦ নেই ফায়ার এক্সিট ♦ দেওয়া হয় ছাদ ভাড়া ♦ নিরাপত্তার কথা ভাবে না কেউ

হাসান ইমন

মৃত্যুঝুঁকি বাণিজ্যিক ভবনে

আগুনে পুড়ে যাওয়া বেইলি রোডের ভবনটি গতকাল সিলগালা করে দেওয়া হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ ভবন উঠেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ফায়ার সার্ভিসের নিয়মনীতি পুরোপুরি না মেনে। এসব ভবনে অগ্নিসংকেতের ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যাপ্ত পানি ও আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। থাকে না পর্যাপ্ত সিঁড়ি। আবার অনেক সিঁড়ি উন্মুক্ত নয়। বাণিজ্যিক ভবনে সিঁড়িতেও বসানো হয়েছে দোকানপাট-গুদাম। এসব ভবন মালিকরা ছাদে রেস্টুরেন্টসহ বাণিজ্যিক দোকান ভাড়া দিয়ে থাকেন। নেই জননিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা। এমনকি মার্কেট-শপিংমল ভবন-সংলগ্ন অবস্থায় যেখানে-সেখানে ঝুলছে বৈদ্যুতিক তার ও এসি যন্ত্রের সংযোগ। সব মিলে ঢাকার বহুতল বাণিজ্যিক ভবনগুলো অগ্নিকাণ্ড ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলো এক একটা যেন মৃত্যুফাঁদ। জানা গেছে, উত্তরা, বনানী, গুলশান, নিকুঞ্জ, ধানমন্ডি, বারিধারা, পল্টন, কারওয়ান বাজারসহ আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় অনেক বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। এগুলোর অধিকাংশই রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা না মেনে তৈরি। আগুন লাগলে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার পথ ‘ফায়ার এক্সিট’ নেই। সিঁড়ি থাকলেও সেখানে দোকান ও গুদাম হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভাড়া দিয়ে রাখা হয়। ওঠানামার জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় লিফট। সিঁড়ির ব্যবহার কম থাকায় সিঁড়িও ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ভবন মালিকরা লাভের স্বার্থে ছাদও ভাড়া দিয়ে দেন। যেগুলোর অধিকাংশই রেস্টুরেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ছাদে যে আশ্রয় নেবে সেই সুযোগও থাকে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবন মালিকরা একটু জায়গাও ছাড়তে চান না। সিঁড়ি, ছাদ, ভবনের শেড ব্যাকসহ যে জায়গাটুকু খালি থাকে সবগুলোয় ব্যবসাকেন্দ্র। একই সঙ্গে রাখে না অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সরঞ্জাম। ফলে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে আগুনের ঝুঁকি।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি অবহেলাজনিত। ভবন উঠানোর জন্য রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ ছয়টি সংস্থার বাণিজ্যিক অনুমোদন নিতে হয়। ভবনটিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালাসহ যেসব নিয়ম-কানুন মানা দরকার ছিল তার কোনোটি মানা হয়নি। নগরে এখনো কাচ ব্যবহৃত ও আবদ্ধ ভবন তৈরি হচ্ছে। যেগুলোয় বাড়ছে বিদ্যুৎ ও এসি ব্যবহার। এগুলোর ব্যবহার বন্ধ করতে আমরা বারবার বলে আসছি। রানা প্লাজা ঘটনার পর আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর যেভাবে পরিবর্তন হয়েছিল, এখন দরকার আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন পরিবর্তনের বিপ্লব। সরকার চাইলে গার্মেন্টস সেক্টরের মতো এসব ভবনও শৃঙ্খলায় আনা সম্ভব। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে বাণিজ্যিক ভবনে রেস্টুরেন্ট খোলা হচ্ছে অহরহ। এগুলো এক ধরনের টাইম বোমা। সরকার ইচ্ছে করলে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে এগুলো নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদারকি অপরিহার্য। বিশেষ করে বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় ফায়ার এক্সিট, পর্যাপ্ত সিঁড়ি, অগ্নিদুর্ঘটনার যন্ত্রাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে ভবনের ছাদ ও সিঁড়ি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার রোধ করতে হবে। আর এগুলো ব্যবহারে মানুষের নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছে। রাজউক জানিয়েছে, ভবনটির অনুমোদন আট তলার। শুধু আট তলায় আবাসিক স্থাপনার অনুমোদন আছে। এই ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পোশাকের দোকানের অনুমোদন ছিল না। এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভবনটির এক থেকে সাত তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। তবে তা শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ভবন মালিক ব্যবহারের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, গ্লাসনির্মিত ভবন আমাদের জন্য অ্যালার্মিং। কারণ গ্লাস নির্মিত ভবনগুলোতে জানালা নেই। ধোঁয়া বের হওয়ার কোনো জায়গা নেই। একই সঙ্গে ভবনে গরম তৈরি করে। আর দুর্ঘটনা ঘটলে ধোঁয়া বের হওয়ার জায়গা না থাকায় মৃত্যু বেশি হচ্ছে। তবে গ্লাসনির্মিত ভবন করতে অবশ্যই ফায়ার রেটেড গ্লাস ব্যবহার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, নগরে অনেক বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে, সেগুলোতে রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ আন্তসংস্থার একটি টিম তদারকি করছে। এই টিমের প্রধান রাজউক চেয়ারম্যান। এই টিম মাসে এক দিন করে পরিদর্শন করছে। যে ভবনগুলোতে ব্যত্যয় খুঁজে পাচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর