সোমবার, ৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

ধুলায় কাবু রাজধানীবাসী

নির্মাণবিধির বালাই নেই, শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত মানুষ, সভা-সেমিনারে দায় সারছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো

শামীম আহমেদ

ধুলায় কাবু রাজধানীবাসী

ভয়াবহ ধুলা দূষণের কবলে রাজধানীবাসী। ধুলার পুরু আস্তর জমে বিবর্ণ হয়ে গেছে গাছের পাতা। বদলে গেছে দালানকোঠার রং। দোকানের সাইনবোর্ডের লেখা ঢেকে গেছে ধুলায়। পথে বের হলে কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে জমছে ধুলাবালি, ঢুকছে নাক-মুখ দিয়ে। রাস্তার ধুলা ঢুকছে ঘরে। দিনে একাধিকবার মুছতে হচ্ছে ফ্লোর-আসবাবপত্র। দূষিত বায়ুতে ঘরে ঘরে অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশির রোগী। বৃষ্টিপাত বন্ধের পর গত অক্টোবর থেকে টানা পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে এই বিষবায়ু সেবন করছে রাজধানীবাসী। প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকার নাম। গত অক্টোবর থেকেই মারাত্মক দূষিত ঢাকার বাতাস। প্রায়ই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের খেতাব লাগছে জনবহুল এই নগরীর গায়ে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত দুই মাসে এক দিনও নির্মল বাতাস পায়নি ঢাকাবাসী। ৩১ দিনের মধ্যে ছয় দিন ঢাকার বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর, ২৪ দিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর ও এক দিন ছিল বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত। জানুয়ারিতে বাতাসে দূষণের মূল উপাদান পিএম ২.৫ (অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা)-এর গড় ছিল সহনশীল মাত্রার চেয়ে ৩৭ গুণ বেশি। কখনো কখনো তা ৫০ গুণ ছাড়িয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে ১৬ দিন ছিল অস্বাস্থ্যকর, বাকি দিনগুলো ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। গতকাল বিকাল ৩টায়ও ঢাকা ছিল বিশ্বের ১১৭টি বড় শহরের মধ্যে তৃতীয় দূষিত বায়ুর শহর। বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) মতে, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয় অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং নির্মাণকাজ থেকে, যা মোট দূষণের ৩০ শতাংশ। এদিকে দূষিত বায়ুর কারণে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। খিলক্ষেতের বাসিন্দা রুকাইয়া ইসলাম বলেন, সকালে দুই বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। আমার ডাস্ট অ্যালার্জি আছে। গত শীতের শুরু থেকেই হাঁচি, শুষ্ক কাশি ও সর্দিতে ভুগছি। দুই বাচ্চাও অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকছে। ওষুধ খেলে কয়েকদিন ভালো থাকে, আবার হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকার পিচঢালা সড়কের দুই পাশ থেকে কয়েক ফুট ঢেকে গেছে ধুলাবালিতে। যানবাহন চলার সময় পেছনে ধুলায় ধূসর হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। কয়েক মাস আগে উদ্বোধন হওয়া পূর্বাচলের ৩০০ ফুট শেখ হাসিনা সরণির স্টিলের রেলিংগুলো ধূসর হয়ে গেছে ধুলায়। রাজধানীর দুই সিটিতেই চলছে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির খেলা। অনেক সড়কের মাটি কেটে তুলে রাখা হয়েছে ছয় মাস আগে। এরপর আর কাজ এগোয়নি। ধুলায় সয়লাব এসব সড়কের আশপাশের দোকান, বাড়িঘর। উন্মুক্ত ট্রাকে পরিবহন করা হচ্ছে ইট, বালু, সিমেন্ট। যাওয়ার সময় এসব ট্রাক থেকে সড়কে বালু যেমন পড়ছে, পাশাপাশি উড়াচ্ছে বালু। গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত নির্মাণাধীন ৪৮ কিলোমিটার ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে ২০২২ সালে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় কয়েক দফা পিছিয়ে মেয়াদ ২০২৫ সালের জুলাইয়ে গিয়ে ঠেকেছে। গত শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, পুরো সড়কটি যেন ধুলা উড়ানোর কারখানা। নেই ধুলা নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা। যানবাহন চলাচলের সময় এই সড়কের ধুলা আশপাশের কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। একইভাবে এক যুগের বেশি সময় ধরে চলমান বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) প্রকল্পটি বিমানবন্দর, উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুরবাসীর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধুলা দূষণে জর্জরিত এসব এলাকার বাসিন্দারা। ধুলার আস্তর জমেছে উত্তর সিটি করপোরেশনের ধুলা পরিষ্কারের সুইপার ট্রাকগুলোর ওপরও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বছর বিভিন্ন সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তা খুঁড়ে বছরব্যাপী রেখে দেওয়া, ধুলা নিয়ন্ত্রণ না করে সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজ, মেগা প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়া, সড়কজুড়ে আবর্জনা ফেলা, ট্রাকে উন্মুক্ত অবস্থায় নির্মাণসামগ্রী পরিবহনসহ নানা কারণে ঢাকার দূষণ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আগে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ছিল ইটভাটা। বর্তমানে শহরের মধ্যে নির্মাণাধীন ভবন থেকে বেশি দূষণ হচ্ছে। কোথাও নিয়মের বালাই নেই। অথচ নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া ঢাকা শহরে কয়েক শ রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি অবস্থায় আছে। এক সংস্থা রাস্তা খুঁড়ে যাওয়ার পর আরেক সংস্থা খুঁড়ছে। সেখান থেকে গাড়ির চাকার মাধ্যমে ধুলাবালি সব জায়গায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়িও বেড়েছে। এর জন্য কাউকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বায়ুদূষণ মোকাবিলায় নির্মল বায়ু অ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আজ অবধি তা আলোর মুখ দেখেনি। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ দিবসে সভা, সেমিনার, র‌্যালিতেই দায় সারছে। বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২ এ বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে তা থেকে স্বাস্থ্যক্ষতি এড়াতে পরিবেশ অধিদফতর জনগণকে সতর্কবার্তা দেবে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেবে। আইনটি প্রণয়নের প্রায় দুই বছর পার হলেও জনগণকে সতর্কবার্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক পরামর্শের কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি পরিবেশ অধিদফতর। বায়ুদূষণ কমাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট রুল দিয়ে কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেন। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন চেয়ে গত জানুয়ারিতে বেলা আবার সম্পূরক আবেদন করে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি বায়ুর মানমাত্রা অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে পৌঁছালে তা থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় নির্দেশনা-সংবলিত অ্যালার্ট পদ্ধতি চালুর নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। তবে এখন পর্যন্ত এই অ্যালার্ট পদ্ধতি চালু হয়নি। এমনকি দূষণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও দৃশ্যমান নয়।

সর্বশেষ খবর