মঙ্গলবার, ৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আবাসিক ভবনে অরাজকতা

বহুতল ভবনের পুরোটাই রেস্টুরেন্ট, সরু সিঁড়ি, একই ভবনে স্কুল

নিজস্ব প্রতিবেদক

আবাসিক ভবনে অরাজকতা

ভবনজুড়েই রেস্টুরেন্ট। খিলগাঁও থেকে তোলা ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

খিলগাঁও চৌরাস্তা থেকে রেলগেটের দিকে এগোলে সাত তলা একটি ভবনের দিকে আপনার চোখ আটকে যাবে। যার হোল্ডিং নম্বর ৪৩৪ ব্লক সি। বাড়িটির ছাদে কয়েকটি গাছ উঁকি দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাড়িটির সামনের ফুটপাতেও রয়েছে দুটি গাছ। এই বাড়ির নিচ তলার এক পাশে একটি মুদি ও স্টেশনারির দোকান। সেই দোকান ঘেঁষে কাউবয় নামের একটি রেস্টুরেন্ট। নিচতলারই আরেক পাশে একটি স্কুলের গেট ও রিসিপশন। দোতলায় শোভা পাচ্ছে ‘কোয়ালিটি এডুকেশন কলেজ’ খচিত একটি সাইনবোর্ড। এটি একটি কলেজ। নিচতলায় আরেকটি ব্যানার সংবলিত সাইনবোর্ড ও অস্থায়ী গেট। ব্যানারে লেখা প্লে, নার্সারি, জুনিয়র ওয়ান ও প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি চলছে। এটা বুঝতে কারওই অসুবিধা হয় না যে, এটি একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এই ভবনের চার তলায় ভবনের মালিকের বাসা। ভবনের বাকি ফ্লোরগুলো স্কুল ও কলেজ। অথচ একটি একটি আবাসিক প্লট। বাড়িটি নির্মাণও করা হয়েছে আবাসিক ভবন হিসেবে। কিন্তু ব্যবহার হচ্ছে বাণিজ্যিক হিসেবে। এলাকাবাসী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিচ তলায় দোকান ও রেস্টুরেন্ট ভাড়ার বিরোধিতা করেও কোনো কাজ হয়নি। বাড়িওয়ালা নিজ ক্ষমতায় ভাড়া দিয়ে রেখেছেন বছরের পর বছর। খিলগাঁও আবাসিক এলাকার তিনটি ব্লক এ, বি ও সি। খিলাগাঁও রেলগেট থেকে আবুল হোটেল ও মালিবাগের প্রধান সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী শহীদ বাকী সড়কটিই এই এলাকার প্রধান সড়ক। এই রোডের দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একতলা, দোতলা থেকে ৬, ৮ ১০ বা তারও বেশি উচ্চতার ভবনগুলো আবাসিক ভবন হলেও সবগুলোতেই রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছে। এমন ভবনও আছে যেটার প্রত্যেক ফ্লোরে একাধিক রেস্টুরেন্ট ছয়, সাত তলা পর্যন্ত। যেগুলো প্রত্যেকটিই একেকটি মৃত্যুকূপ।

তালতলা থেকে সড়কটি ধরে আবুল হোটেলের দিকে এগোলে সারি সারি যত ভবন চোখে পড়বে সবগুলোই আবাসিক। কিন্তু এসব ভবনের প্রত্যেকটিই এখন বাণিজ্যিক ভবন। খাবারের দোকান, ফ্যাশন হাউস, অফিস ও দোকানপাটে ভরা। শহীদ বাকী সড়কের চৌধুরীপাড়ার অংশে ‘একাডেমিয়া ইংলিশ মিডিয়া’ স্কুলের একটি শাখা রয়েছে। এই স্কুলটি যে দুটি ভবন নিয়ে গড়ে উঠেছে তার একটির নিচতলায় রয়েছে রেস্টুরেন্ট। এই ব্লকের পাঁচতলায় একটি ভবন চোখে পড়বে, যার প্রতিটি ফ্লোরজুড়েই রেস্টুরেন্ট। এখানে রয়েছে ‘অলিভারস’, ‘ক্যাফে এপিলিয়ানো’, ‘ট্রেডিশনাল’, ‘পিৎজবার’ নামের বাহারি রেস্টুরেন্ট। ছাদে আলো ঝিকমিক লাইটিং করে বসানো হয়েছে আরেকটি রেস্টুরেন্ট। যার নাম ‘সানসেট লাউঞ্জ’।

সন্ধ্যার পর খিলগাঁও এলাকায় এলে, তালতলা মোড়ে আপনার চোখ আটকে যাবে একটি চিকন (সরু) ভবনে। যেটি আবার সাত তলা ভবন। এ ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে একাধিক রেস্টুরেন্ট। এ ভবনে রয়েছে ‘পাস্তা ক্লাব’, ‘থ্রি ডোর’, ‘ক্যাফে সুইট অ্যান্ড সেভরি’, ‘ক্যাফে আইপেনিমা’, দোতলায় রয়েছে ‘শর্ম হাউস’ এবং নিচ তলায় ‘ভগ’ এর শো-রুম। এই ভবনটি ওঠানামার জন্য রয়েছে একটি ছোট্ট লিফট ও সরু সিঁড়ি। নেই কোনো ফায়ার এক্সিট। ভবন ঘেঁষেই রয়েছে একটি বুহৎ বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার। এর পাশে রয়েছে ‘চিটাগাং বুল’ নামের একটি রেস্টুরেন্ট। যার নিচতলায় ফার্মেসি। ছাদে রয়েছে ‘গার্ডেন ক্যাফে’ নামের আরেকটি রেস্টুরেন্ট। রয়েছে অপ্রশস্ত সিঁড়ি। এসব ভবনের কোনোটিতেই নেই কোনো ফায়ার এক্সিট।

তালতলা মাকের্টের উল্টো দিকে একটি বাড়িতে একই সঙ্গে রয়েছে একটি হোটেল, যার নাম ‘মোল্লা হোটেল অ্যান্ড ফাস্ট ফুড’ এবং ওষুধের দোকান ‘এন হক ফার্মা’। একই ভবনের পেছনে রয়েছে ‘ডেন্টাল ক্লিনিক’। দোতলায় রয়েছে ‘থেরাপি সেন্টার’। ওপরের তলায় বাড়ির মালিকের বসবাসের ফ্ল্যাট।

সরেজমিনে খিলগাঁও আবাসিক এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। শহীদ বাকী সড়কের দুই পাশে এমনভাবে গড়ে উঠেছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান, কফি শপ- মনে হবে যেন এ-অঞ্চলটি একটি খাবারের হাট। এলাকার যেসব ভবন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটারই পার্কিং নেই। ফলে বাইরে থেকে আসা দর্শনার্থী বা খাবার খেতে আগতদের গাড়ি, মোটরসাইকেল পার্কিং করা হয় রাস্তার ওপর। এতে রাস্তাটি সরু হয়ে যায়। ফলে বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত স্থানীয় শহীদ বাকী সড়কের দুই পাশজুড়ে লেগে থাকে তীব্র যানজট। দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এলাকাবাসী। হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনাও। আবাসিক এলাকাগুলোর ভিতরের রাস্তাগুলোতেও রেস্টুরেন্ট আর নানা রকম খাবারের দোকানে ভরপুর।

অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে খিলগাঁওয়ে গড়ে ওঠে ১৯৬০ সালে। তখন কমলাপুর রেলস্টেশন নির্মাণকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে খিলগাঁওয়ে পুনর্বাসন করা হয়। বর্তমানে সেই আবাসিক এলাকার অনেক বসতবাড়িতে এখন স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁসহ বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, অতিরিক্ত ভাড়া ও ‘অ্যাডভান্সে’র টাকার লোভে বাড়ির মালিকরা আবাসিক ভবনগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিতেই বেশি আগ্রহী। যার ফলে খিলগাঁও আবাসিক এলাকাটি তার আবাসিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। গত ৫/৭ বছরে এলাকাটি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কোথাও নেই কোনো রকম অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। গত দুই তিন বছরে এখানে বিএফসিসহ কয়েকটি ভবন ও খাবারের দোকানে ছোটখাটো একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় বড় কোনো প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও যে কোনো দিন এখানে ঘটতে পারে চুড়িহাট্টা, নিমতলী, বনানী কিংবা বেইলি রোডের চেয়েও ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ঘটতে পারে বড় রকমের হত্যাকাণ্ড। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় কাউন্সিলর সাখাওয়াত হোসেন শওকত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ এলাকায় কিছু বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে। তবে কোনো আবাসিক ভবনের যদি বাণিজ্যিক ব্যবহার হয়ে থাকে তাহলে তা খতিয়ে দেখা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রক-১ মোহাম্মদ সামছুল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ধানমন্ডিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজউকের বাকি অঞ্চলগুলোতে কর্মকর্তারা ভবনের ব্যত্যয় আছে কি না তা জানতে পরিদর্শন করছেন। রাজউকের অভিযান বাড়ানোর ফাইল উঠানো হয়েছে। পুলিশ পাওয়া গেলে বুধবার থেকে আরও দুটি টিম মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। একই সঙ্গে যেসব আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে সেখানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর