শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

পাল্টাপাল্টি হামলায় প্রকম্পিত রাখাইন

টেকনাফ সীমান্তের ২১ গ্রাম কাঁপছে বিস্ফোরণের শব্দে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় সতর্ক বিজিবি-কোস্টগার্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক ও টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি

মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ঘাঁটি ও সীমান্তচৌকি দখল-পুনর্দখল নিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলায় কাঁপছে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া রাখাইন রাজ্য। বৃহস্পতিবারও রাতভর গ্রেনেড-মর্টার শেল বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির বিকট শব্দে বারবার কেঁপে ওঠে টেকনাফের সীমান্তবর্তী ২১টি গ্রাম। গতকাল বিকাল ৩টা পর্যন্ত থেমে থেমে আসে গুলির শব্দ। আকাশে দেখা যায় বিমানের মহড়া। আতঙ্কে গ্রামগুলোর স্বাভাবিক জনজীবন থমকে গেছে। রাখাইনের সঙ্গে টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানির সীমান্ত বাণিজ্যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে।সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, রাখাইন রাজ্য ঘিরে সেখানকার মংডু শহরের আশপাশের কয়েকটি গ্রামে তুমুল যুদ্ধ চলছে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা পাঁচ দিন ধরে মিয়ানমারের আকাশে দেখতে পাচ্ছেন ভিন্ন দৃশ্য। বেশির ভাগ সময় দেখা যাচ্ছে হঠাৎ দিনের আকাশে বিমান চক্কর দিচ্ছে, ঠিক তখনই বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পান এপারের বাসিন্দারা। এরপরই আকাশে ভেসে ওঠে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। তবে দিনের চেয়ে রাতে অনেক বেশি বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মৌলানা মুজিবুর রহমান বলেন, গতকাল সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বিমান মহড়া দিতে দেখা গেছে। এ সময় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেসে ওঠে। ধারণা করা হচ্ছে- মিয়ানমারের মংডু শহরের আশপাশের গ্রাম থেকেই এই শব্দ ভেসে আসছে।

সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়, রাখাইন রাজ্যের জেলা শহর মংডু টাউনশিপসহ উত্তর দিকের কুমিরখালী, বলিবাজার, নাকফুরা, নাইচাডং, কোয়াচিডং, কেয়ারিপ্রাং, পেরাংপ্রুসহ কয়েকটি গ্রামে দেশটির স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘাত তীব্রতর হয়েছে। মূলত আরাকান আর্মির দখলে চলে যাওয়া সীমান্তচৌকি ও ঘাঁটি পুনর্দখলের জন্য পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে সে দেশের সেনাবাহিনী। স্থলপথে যোগাযোগব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হেলিকপ্টার ও সামরিক বিমান থেকে হামলা চালানো হচ্ছে। আরাকান আর্মিও ভূমি থেকে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, পাঁচ দিন ধরে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাতে যে পরিমাণ শব্দ শোনা যাচ্ছে, দিনে তেমনটা শোনা যায় না। সীমান্তের মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ কাজ করছে।

এই সংঘাতের জেরে গত রবিবার থেকে রাখাইনের সঙ্গে টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয় আছে। রাখাইনের সিথুয়ে বন্দর থেকে টেকনাফে আমদানি পণ্যবাহী কোনো কার্গো ট্রলার কিংবা জাহাজ আসছে না। এ ব্যাপারে টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্টের মহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, রাখাইনে দেশটির যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। স্থলবন্দরের শুল্ক বিভাগের কাস্টমস সুপার বি এম আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় প্রতিদিন অন্তত ৩ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় হচ্ছে না।

এদিকে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতীর খবরে বলা হয়, রাখাইন ছাড়াও মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তুমুল সংঘাত চলছে দেশটির সরকারি বাহিনীর। গত বৃহস্পতিবার সকালে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) ও এর মিত্র গোষ্ঠীগুলো চীন সীমান্তের কাছে ১০টিরও বেশি জান্তা চৌকিতে আক্রমণ করে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কেআইএর মুখপাত্র কর্নেল নাও বুকে বলেন, জাতিগত সেনাবাহিনী লাইজার কাছে একটি পাহাড়ের চূড়ার ঘাঁটি দখল করে নেয় এবং ঘাঁটি রক্ষাকারী ১০টি ক্যাম্পে জান্তা সৈন্যদের পরাজিত করে। এর আগে গত রবিবার কাচিন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর আরও তিনটি ঘাঁটি দখলে নেয় কেআইএ ও এর মিত্র গোষ্ঠীগুলো।

এদিকে রাখাইনে সংঘাত বাড়ায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বারবার আশ্বাস দিয়েও ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদে ও সীমান্তে টহল বাড়ানো হয়েছে।

অনুপ্রবেশকারীর ছোড়া গ্রেনেডে আহত কৃষকের মৃত্যু : মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের সময় কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী সশস্ত্র এক ব্যক্তির ছোড়া গ্রেনেডে আহত বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত আনোয়ার সালাম মোবারক (৩২) উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ রহমতের বিল এলাকার আবদুস সালামের ছেলে। পালংখালী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলতাজ আহমদ বলেন, গত ৭ ফেব্রুয়ারি মোবারক সীমান্তবর্তী জমিতে কাজ করছিলেন। এ সময় তিনি মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী এক যুবককে দেখতে পেয়ে আটকানোর চেষ্টা করেন। অনুপ্রবেশের চেষ্টা করা লোকটির হাতে থাকা একটি গ্রেনেড মোবারককে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। দীর্ঘ এক মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তিনি মারা যান। প্রসঙ্গত, চলমান পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড ৪ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ অনুপ্রবেশের সময় নারী, শিশুসহ ১৪ রোহিঙ্গাকে আটক করে ফেরত পাঠানো হয়।

 

সর্বশেষ খবর