রবিবার, ১০ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
হাসপাতালে অনিয়মের শেষ নেই

বিষফোড়া আউটসোর্সিং কর্মী

♦ বারবার কর্মী বদলে ঝুঁকিতে হাসপাতালের নিরাপত্তা ♦ ছয় মাস বেতন পাননি এই কর্মীরা ♦ বাড়ে দালালের দৌরাত্ম্য

জয়শ্রী ভাদুড়ী

সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন পলি খাতুন। আনন্দের এ খবরের মাঝেই দুঃখের ছায়া ঘিরে ধরে পুরো পরিবারকে। হাসপাতাল থেকে চুরি হয়ে যায় এক শিশু। এ ঘটনায় আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে হাসপাতালে কর্মরত নিরাপত্তা কর্মী, আয়াসহ কয়েকজনকে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ।

হাসপাতালের আউটসোর্সিংয়ের এই কর্মীদের দিকে নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ এই প্রথম নয়। দালালচক্রে জড়িয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে আউটসোর্সিংয়ে কর্মরতদের বিরুদ্ধে। প্রায়ই বন্ধ থাকে বেতন। ছয় মাস বেতন না পাওয়ায় মানবেতর জীবনে বিপদগ্রস্ত এই কর্মীরা। আউটসোর্সিংয়ে এই কর্মী নিয়োগে বিপুল অঙ্কের ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। নির্ধারিত কয়েক বছরের চাকরির মেয়াদ শেষে চুক্তি নবায়নে দায়িত্ব পাওয়া এজেন্সিকে দিতে হয় ঘুষ। অনেক সময় বেতনের অংশ থেকেও প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক দিতে হয় ঘুষ হিসেবে। এই কর্মীদের স্থায়ী না করায় নানামুখী সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে হাসপাতাল প্রশাসনকে। দীর্ঘদিন এক জায়গায় কাজ করায় অনেক সময় প্রভাবশালী হয়ে ওঠে অনেক কর্মী। হাসপাতালের দীর্ঘদিন কাজ করায় এর প্রতিটি বিষয় নখদর্পণে থাকে তাদের। পরবর্তীতে চুক্তি নবায়ন না হলে সাবেক এই কর্মীরা হাসপাতালের রোগী ও সরঞ্জামের নিরাপত্তার ঝুঁকি হিসেবে দেখা দেয়।

আউটসোর্সিং নিয়ে এক শ্রেণির ঠিকাদার রীতিমতো দোকান খুলে বসেছেন। তারা আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে দিব্যি অপকর্ম করে চলেছেন বছরের পর বছর। তাদের সঙ্গে অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়েছেন এসব অপকর্মের সহযোগী হিসেবে। বিনিময়ে তারাও পাচ্ছেন অবৈধ টাকার ভাগ। সরকার নির্ধারিত ৫ শতাংশ কমিশনের বাইরে তারা বেতন থেকে টাকা কেটে রাখছেন এবং চাকরি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

জানা যায়, দীর্ঘকাল ধরে নিয়মিতভাবে নিয়োগের অভাবে হাসপাতালে এসব জনবলের তীব্র ঘাটতি মোকাবিলার অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে আউটসোর্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে এসব জনবল নিয়োগের ধারা চালু হয়। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে ২০তম গ্রেড বা চতুর্থ শ্রেণির ছয়টি (যথা পরিচ্ছন্নতা কর্মী, আয়া, ওয়ার্ড বয়, নিরাপত্তা প্রহরী, মালি, বাবুর্চি ও কুক/মশালচী) পদে স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে আউটসোর্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

মানিকগঞ্জ সিংগাইর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. সৈয়দা তাসনুভা মারিয়া বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে আটজন আউটসোর্সিংয়ের কর্মী রয়েছেন। তারা প্রায় ছয় মাস ধরে বেতন পাচ্ছে না। যারা স্থায়ী কর্মী তাদের বেতনে কোনো সমস্যা নেই। উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালে নিরাপত্তা রক্ষী নেই, আনসার নেই। রোগী ও হাসপাতালের সার্বিক বিষয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে কর্মী বদলে গেলে আরও মুশকিল বাড়ে। আউটসোর্সিংয়ের কর্মীদের চাকরি স্থায়ী করে বিভাগের মধ্যে বদলির ব্যবস্থা করলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।’ এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ করে হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, আয়া, ওয়ার্ড বয়, নিরাপত্তা প্রহরী, মালি, বাবুর্চি ও কুক/মশালচী পদে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগদান কতটুকু যুক্তিসংগত তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আউটসোর্সিং ব্যবস্থায় দ্রুত শূন্য পদে জনবল নিয়োগ এবং মঞ্জুরিকৃত পদের থেকে বেশি জনবল নিয়োগ করার সুযোগসহ বেশ কিছু সুবিধা থাকলেও অসুবিধার পাল্লাই বেশি ভারী। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে আউটসোর্সিং ব্যবস্থার অর্থায়ন পরিচালন বাজেটের আওতায়। ফলে প্রতি বছর নতুনভাবে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে হয়। আর এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অর্থবছরের প্রায় অর্ধেক লেগে যায়। এ সময় আউটসোর্সিং স্টাফরা বেতন পায় না। তিনি আরও বলেন, ‘এই কর্মীরা ঠিকঠাক মতো কাজ না করলে বা নিয়মিতভাবে কাজে না এলে হাসপাতাল প্রশাসনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। এসব কারণে আউটসোর্সিং স্টাফদের সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে গাফিলতিসহ নানা অনিয়মে জড়িত থাকার শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে রোগী, রোগীর স্বজন, নার্স এবং মহিলা ডাক্তার এবং নার্সদের নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। হাসপাতালের বিভিন্ন সম্পদ চুরি বা ক্ষতির শঙ্কা তো আছেই। আবার সংগঠিত ক্রাইম ঘটানোরও শঙ্কা তৈরি হতে পারে। তাই আউটসোর্সিং পদ্ধতির বিকল্প ভাবতে হবে। একটি বিকল্প হলো আগের মতো স্থায়ী নিয়োগে ফিরে যাওয়া। তবে, এ ক্ষেত্রে প্রতি দু-তিন বছর পর পর জেলা কিংবা বিভাগের মধ্যে ট্রান্সফার-এর বিধান রাখতে হবে এবং তা জোরালোভাবে কার্যকর করতে হবে। আরেকটি বিকল্প হলো সিভিল সার্জন অফিস বা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল প্রশাসনের মাধ্যমে বাৎসরিক পারফরমেন্সের ভিত্তিতে নবায়নের বিধান রেখে সরাসরি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। এ প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর নিয়োগের প্রয়োজন না থাকায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত স্টাফদের নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রাপ্তিতে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।

সর্বশেষ খবর