রবিবার, ১০ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আড়াই হাজার কোটি টাকার অপেক্ষায় ৩ লাখ গ্রাহক

যুবক-এর প্রতারণার ১৮ বছর

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি নতুন করে কার্যক্রম শুরু করলেও প্রায় দেড় যুগ ধরে বন্ধ থাকা আরেক প্রতিষ্ঠান যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক)-এর ভাগ্যে কী আছে বলতে পারছে না কেউ। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় তিন লাখ গ্রাহকের আড়াই হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এর বিপরীতে সারা দেশে যুবক-এর স্থাবর-অস্থাবর যে সম্পদ রয়েছে তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই সম্পদ হেফাজতে নিয়ে অর্থ ফেরত দেওয়ার উপায় বের করতে দুটি কমিশন ও একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছিল সরকার। বেশ কিছু সুপারিশও জমা হয়েছিল। বলা হয়েছিল প্রশাসক বা রিসিভার নিয়োগের কথা। একের পর এক আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। বছরের পর বছর চলে গেছে। বাস্তবায়ন হয়নি কমিশনের সুপারিশ। আসেনি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত।

যুবক-এ ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন মুকুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যুবক বিষয়ে ২০০৬ সালে শুরু হয়েছিল তদন্ত কার্যক্রম, এটি ২০২৪ সাল! টাকা ফেরত পেতে এ ‘অপেক্ষা’র বয়স এখন আঠারো বছর! ‘যুবক’ আমাদের কাছে এখন আঠারো বছর ধরে বয়ে নিয়ে চলা এক বিষফোঁড়ার নাম।

মুকুল জানান, বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার আশায় সচিবালয়ে এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে ঘুরেছি; দিনের পর দিন কাগজপত্র, ফাইল নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেছি- একটি সিদ্ধান্তও আসেনি। শেষে নিরুপায় হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকেরা মিলে নিজেরাই চাঁদা দিয়ে কিছু টাকা সংগ্রহ করে আদালতে রিট দায়ের করেছি। আমরা এখন সেই রিটের আদেশের অপেক্ষায় আছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, রিট দায়েরের পর উচ্চ আদালত ‘যুবক’ বিষয়ে সরকারের গঠিত কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ সম্পর্কে ৯০ দিনের মধ্যে জানানোর রুল জারি করেছিল। আমরা যথাসময়ে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন আদালত বিষয়টির শুনানি করে প্রশাসক বা রিসিভার নিয়োগে যে নির্দেশনা দেবেন, সে অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে বেকার যুবকদের কম্পিউটার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে কার্যক্রম শুরু করে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক)। ১৯৯৭ সালে বেসরকারি সংস্থা হিসেবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (রেজসকো)-এর দফতর থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। শুরু করে গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ কার্যক্রম। এক দশকের মধ্যে সংস্থাটি উচ্চ সুদের লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকার মূলধন গড়ে তুলে। টেলিকম, পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা, সিরামিক, হাউজিং এস্টেট, সমুদ্র খাদ্য, নার্সারি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি এবং আর্থিক কর্মকাণ্ডসহ প্রায় ২০টি সহযোগী সংস্থা গড়ে তোলে। প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক কোম্পানি না হয়েও গ্রাহকদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছিল; এসব আমানত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো নিরাপত্তা সঞ্চিতি ছিল না; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান রেজসকো এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদফতর থেকে নিবন্ধন নিয়েই ব্যক্তির আমানত সংগ্রহ ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে- যা ছিল আইনের চোখে অবৈধ। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। তদন্ত কমিশনের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের মে মাসে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৫১ ও ৫২ ধারার আওতায় যুবককে তার আমানত সংগ্রহ ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম কেন অবৈধ ঘোষণা হবে না- কারণ জানতে চেয়ে নোটিস দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক যুবকের সব ধরনের আমানত সংগ্রহ ও ঋণ কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আমানতকারীদের কাছ থেকে আদায় করা সব টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই থেকে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অপেক্ষা টাকা ফেরত পাওয়ার। এ সময়ে যুবকের ফাইল অর্থ থেকে বাণিজ্য, বাণিজ্য থেকে আইন, আইন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চালাচালি হলেও মেলেনি কোনো ফল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। ওই কমিশন যুবকের দায়দেনা ও সম্পদের হিসাব সংগ্রহ করে, ওই সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের সুপারিশ করে। ২০১১ সালে অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করে সরকার। কিন্তু আইনি জটিলতায় ওই কমিশনও সম্পদ হেফাজতে নিয়ে অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নিতে পারেনি। দুই বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৩ সালে অর্থমন্ত্রীকে ১৪টি সুপারিশ সংবলিত একটি প্রতিবেদন পাঠিয়ে বিদায় নেয় রফিকুল কমিশন। এই কমিশন প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে যুবকের সম্পদ হেফাজতে নিয়ে তা বিক্রির মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করে যায়। এরপর শুরু হয় প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে অর্থ, বাণিজ্য ও আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সরকার বাদী হয়ে যুবক চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীসহ ৮ পরিচালকের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। মামলাটি অধিকতর তদন্তে যায় সিআইডিতে। তদন্তের মধ্যেই ওই মামলার প্রধান আসামি যুবক চেয়ারম্যান আবু সাঈদ মারা যায়। শেষে চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে প্রধান নির্বাহী হোসাইন আল মাসুমসহ সাতজনকে আসামি করে চূড়ান্ত চার্জশিট দেয় সিআইডি। এরই মধ্যে সাত পরিচালক জামিনে বের হয়ে যুবকের সম্পদ ভোগ করছেন। যুবক কর্তৃপক্ষ ফরাসউদ্দিন কমিশনকে যে তথ্য দিয়েছিল, সে অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পুরানা পল্টন, ধানমন্ডি ও তেজগাঁওসহ দেশের বিভাগীয় শহরে ১৮টি বাড়ি, ১৮টি প্রকল্পসহ সারা দেশে প্রায় ২ হাজার ২০০ একর জমির মালিক ছিল প্রতিষ্ঠানটি। কার্যক্রম বন্ধের পর কিছু সম্পদ বিক্রি হয়েছে, কোনোটি আবার দখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে আজাদ প্রোডাক্টের পাশে পুরানা পল্টনে বি কে টাওয়ার দখল হয়ে গেছে। এ ছাড়া নেপথ্যে থেকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় যুবকের একটি শিল্প প্লট পরিচালকদের একটি অংশ ভোগ দখল করছে বলে জানা গেছে। ৫৩/১ নয়াপল্টনের একটি চার তলা বাড়ি দখলে নিয়েছে প্রভাবশালী মহল। যুবকের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা জামিনে বের হয়ে নেপথ্যে থেকে সম্পদ বিক্রি এবং ভোগদখলে নেমেছেন। কিন্তু যাদের আমানতের টাকায় এই সম্পদ, তাদের অনেকই টাকা ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা জানান, নামে-বেনামে যুবক-এর যে সম্পদ রয়েছে- আঠারো বছরে তার দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। সবমিলিয়ে এখনো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। সরকার চাইলে এখনো এই সম্পদ বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারে।

 

সর্বশেষ খবর