মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্যের ২২ কোটি টাকা লোপাট

চার দেশে সাত ভুয়া প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ অনুসন্ধানে দুদক

মাহবুব মমতাজী

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৩১ প্যাকেজে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে ২১ কোটি ৭২ লাখ টাকা লুটপাট হয়েছে। চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) আওতায় এসব টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। প্রশিক্ষণের নামে ওইসব টাকা আত্মসাতের ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের তৎকালীন এপিএসের এক ভাইসহ ১১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে আলাদাভাবে এ টাকা পাঠানো হয়। পরে হুন্ডির মাধ্যমে আবার টাকা দেশে এনে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

অভিযুক্ত ১১ জন হলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদ ও লাইন ডিরেক্টর নাজমুল ইসলাম, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার প্রোগ্রাম ম্যানেজার (বৈদেশিক প্রশিক্ষণ) মো. নাসির উদ্দিন, ডেপুটি ম্যানেজার ডা. মোস্তফা কামাল পাশা ও ডা. শামীম আল-মামুন, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. লায়াল হাসান, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. আলমগীর হোসেন, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সুভাষ চন্দ্র দাস, থামাসাট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ড. শেখ আলতাফুর রহমান, থাইল্যান্ডে বসবাসরত সরফরাজ নেওয়াজ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কনসালট্যান্ট ডা. জাবেদ আনোয়ার। এর মধ্যে ড. শেখ আলতাফুর রহমান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. আরিফুর রহমানের ভাই।

কী ঘটেছিল : ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ৪২৬ জনের নামে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়। এতে প্রশিক্ষণার্থীদের দৈনিক সম্মানি, বিমান ভাড়াসহ ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৫ এবং টিউশন, ইনস্টিটিউশনাল ও প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ব্যয় বাবদ ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ১১ হাজার ৪৭২ টাকা অগ্রিম প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়।

দুদকের অনুসন্ধানে যা বেরিয়ে আসে : ২০১৯ সালে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি। ওই বছরের ৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা, শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন শাখা থেকে পৃথক সাতটি স্মারকে প্রশিক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৭২ জনকে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়া জিডি মাল্টি স্পেশালিস্ট হসপিটালের অধীন প্রশিক্ষণের অনুমোদনের কথা বলা হয়। সে অনুযায়ী এ প্রতিষ্ঠানের কথা বলে একটি ইমেইল আইডিতে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব পাঠানো হয়। যে ইমেইল আইডিতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সেটি ভুয়া এবং এটি বাংলাদেশ থেকেই তৈরি করা হয়েছে। মালায়া ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষণের কথা থাকলেও প্রশিক্ষণের ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা পাঠানো হয় থাইল্যান্ডের থামাসাট ইউনিভার্সিটির নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রকৃতপক্ষে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. আরিফুর রহমানের ভাই ড. শেখ আলতাফুর রহমানের। ৪২ জনের মালয়েশিয়ার মাহশা ইউনিভার্সিটি মেডিসিন ফ্যাকাল্টিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুদককে জানানো হয়, এ ধরনের কোনো প্রোগ্রামের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট দেখিয়ে ৭০ লাখ ৩১ হাজার টাকারও বেশি অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫৬ জনকে প্রশিক্ষণের কথা বলে থাইল্যান্ডের পাইথাই নওয়ামিন হসপিটালের নামে এ প্রতিষ্ঠানে দুবারে ৭ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা একটি অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। প্রকৃতপক্ষে ওই প্রতিষ্ঠান ভুয়া। অনুমোদিত ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠান এআইটি নেটওয়ার্কের নামে আটজনকে প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়। অথচ ওই প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলাদেশে বসে তৈরি করা একটি ইমেইল আইডিতে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ওই প্রশিক্ষণের নামে ইন্দোনেশিয়ায় প্রশিক্ষণার্থীদের কথা বলে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। একইভাবে ৫৩ জনের প্রশিক্ষণের কথা বলে আরও ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হয়। অনুমোদনের কথা উল্লেখ করে শ্রীলঙ্কায় নয়জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়। শ্রীলঙ্কার কনকুয়েস্ট সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও আসলে এটি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। সেখানে প্রশিক্ষণের কথা বলে দেশটির একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। ১৮ জনকে ইন্দোনেশিয়ার পিটি এআইটি জেজারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নেওয়া কথা বলা হয়। এ নামে দেশটিতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এটি একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ওই প্রশিক্ষণের কথা বলে দেশটির একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দুবারে ১ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গত পাঁচ বছরে দুবার অনুসন্ধান শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করলেও তা অনুমোদন দেয়নি দুদক।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর প্রথমে এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদকের উপপরিচালক মো. আলী আকবর। এরপর তিনি অভিযোগ-সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যের জন্য নোটিস পাঠালেও তৎকালীন ডিজিসহ আরও অনেকে দুদকে আসেননি। তবে নাজমুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন, সুভাষ চন্দ্র দাস দুদকে উপস্থিত হয়ে তাদের বক্তব্য দেন। পরে কমিশনের সিদ্ধান্তে একই বছরের ২১ নভেম্বর দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক মো. শামছুল আলমকে এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ এক বছর এ অনুসন্ধান থেমে ছিল। পরে কমিশনের সিদ্ধান্তে ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট সহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিনকে এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯ আগস্ট পুনরায় অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান উপপরিচালক আলী আকবর। এর মধ্যে একবার অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও গ্রহণ করেনি দুদক। সর্বশেষ ২৫ নভেম্বর ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন আলী আকবর। এরপর আলী আকবর অবসরকালীন ছুটিতে গেলে নতুন করে এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর