বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে প্রণোদনার শত কোটি টাকা আত্মসাৎ

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য

মানিক মুনতাসির

কোনো প্রকার পণ্য রপ্তানি না করে শুধুমাত্র কাগজে-কলমে রপ্তানি দেখিয়ে এ খাতের বিপরীতে সরকারের দেওয়া শত কোটি টাকার প্রণোদনার অর্থ আত্মসাৎ করছে একটি সিন্ডিকেট। এতে করে একদিকে ডলারের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি অর্থও গচ্ছা যাচ্ছে। কোনো নামি কোম্পানির সঙ্গে মিল রেখে নামের আগে কিংবা পরে দু-একটি শব্দ পরিবর্তন করে কাগুজে কোম্পানি খুলে এমন প্রতারণায় নেমেছে চক্রটি। ডলার সংকটের পেছনে এটিও একটি বড় কারণ বলে মনে করেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। অনেক দিন ধরে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর সম্প্রতি কয়েকটি কোম্পানির রপ্তানি কার্যক্রমকে সামনে রেখে তদন্তে নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। তদন্ত শেষে একাধিক প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়। সেসব প্রতিবেদন ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে। উল্লেখ্য, রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করতে ও বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে রপ্তানি খাতের উপ-খাত ভেদে ১ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ প্রণোদনা দিয়ে আসছে সরকার। অবশ্য সময় সময় এ অঙ্কের হেরফেরও হয়ে থাকে।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে বহুসংখ্যক কাগুজে কোম্পানি রয়েছে যেগুলো ব্যাংক ঋণ, আমদানি-রপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে আসছে। এমন একটি কোম্পানি রাজ কামাল ফুড প্রোডাক্টস। এই কাগুজে কোম্পানির সন্ধান পেয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কোম্পানিটি কখনো ঘোষণার চেয়ে কম আমদানি করে আবার কখনো কখনো কোনো রপ্তানি না করেও সরকারের দেওয়া রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি কাস্টম হাউস চট্টগ্রামের নজরে এলে তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যক্তিগত শুনানিতে উপস্থিত হয়ে জবাব দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় কোম্পানিটির কর্ণধার মোস্তফা কামালকে। যার নথি নম্বর ২২১/এআইআর ২০২১-২০২২ তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ও পত্র ২২২/এআইআর/২০২১-২০২২/১২৮০৭ (কাম); তারিখ ০৫/০২/২০২২ কাস্টমস হাউস চট্টগ্রাম। শুনানিতে দোষ স্বীকার করায় নগদ নেওয়া প্রণোদনার অর্থের ২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ারও অঙ্গীকার করেন কোম্পানিটির কর্ণধার। এ মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি। তার মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমসের তথ্যমতে, এ কোম্পানির নামে সম্প্রতি ৮৭টি রপ্তানি বিল দাখিল করা হয়। পরবর্তীতে এসব বিলের বিপরীতে প্রণোদনার অর্থ তুলে নেওয়া হয়। যার বেশির ভাগ বিল ছিল ভুয়া। এই পন্থায় রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা বাবদ ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে একটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের করপোরেট ব্র্যাঞ্চ মতিঝিলের মাধ্যমে ৩ কোটি ৯০ লাখ ১৮ হাজার টাকা, একটি প্রথম সারির বেসরকারি ব্যাংকের লোকাল অফিস মতিঝিলের মাধ্যমে ১ কোটি ৪১ লাখ ৫ হাজার ১৫৬ টাকা তুলে নেয় কোম্পানিটি। পরবর্তীতে যার পুরোটাই ভুয়া রপ্তানি বলে প্রমাণিত হয়। একইভাবে ২০১৮-২০১৯, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রায় ২ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। ২০২০-২০২১, ২০২২-২৩, ও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও কোটি টাকার ওপরে তুলে নেয় এই চক্র। গত বছরের নভেম্বরে তদন্ত কমিটির নতুন সদস্য সচিব রাজস্ব কর্মকর্তা শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন স্বাক্ষরিত নথি নম্বর ২২১/এআইআর/ ২০২১-২২/৪৯৩১৩ (কাম)-এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শুনানিতে প্রতিনিধি প্রেরণ ও লিখিত জবাবসহ গত ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ চট্টগ্রামে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো তাদের প্রতিনিধি পাঠায়। শুনানির ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনতে ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময় হয়। এমনকি তাদের প্রতিনিধিদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার যাবতীয় ব্যয় বহন করে এসব কাগুজে কোম্পানিই। এদিকে নীতিমালা অনুযায়ী রপ্তানির নগদ প্রণোদনা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নিজস্ব কারখানা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব কাগুজে কোম্পানির কোনো ফ্যাক্টরি নেই। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অফিসের ঠিকানা ভুয়া বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর