শিরোনাম
শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

অনলাইন জুয়ায় সর্বনাশ

বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি, বেশি আসক্ত শিক্ষার্থী ও তরুণরা

মাহবুব মমতাজী

অনলাইন জুয়ায় সর্বনাশ

বাংলাদেশে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। তবে এই জুয়া সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল মাধ্যমে নতুন রূপ নিয়েছে। ঘরে বসেই মানুষ অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলছেন। এখন অনলাইন জুয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। লোভে পড়ে বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণেরা এই জুয়ায় বেশি আসক্ত। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছে তাদের অনেকে। এ কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ।

ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে শুধু অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬ হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। গত বছর এর ব্যাপ্তি ১১.৭ শতাংশ বাড়ার ধারণা দেওয়া হয়। আর এই অনলাইন জুয়ায় বাজারমূল্যের গ্রাফ ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী।

পুলিশ জানায়, ওয়ানএক্সবেট, বেটউইনার, বাবুএইটিএইট, ক্রিকেক্স নামের জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন ইউটিউবে প্রচার হতে দেখা যায়। এই সাইটগুলোর ইউজার বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে এজেন্টের মাধ্যমে এটা পরিচালনা করা হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, ২০২২ সালে অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরা মূলত ফুটবল ক্রিকেটের মতো খেলার আসর ও খেলোয়াড়দের নিয়ে অনলাইনে জুয়ার আসর বসাত। আর গ্রাহকরা অনলাইনে ওই জুয়ার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে মোবাইল নম্বর বা ইমেইলের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলতেন এবং তার বিপরীতে ই-ওয়ালেট খুলে ব্যালান্স যোগ করে ওই টাকায় জুয়া খেলতেন। জুয়া বাবদ মোবাইল ওয়ালেট ছাড়াও ব্যাংকিং চ্যানেলে সে সময় প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আবার অনেকে এজেন্টের মাধ্যমে নগদে জুয়ার টাকা লেনদেন করেছেন। প্রতিটি জুয়ার সাইট দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হওয়ায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, তারা অনলাইন জুয়ার সাইটগুলোতে নিয়মিত নজরদারিতে রাখছে এবং একাধিক সাইট ব্লক করার জন্য বিটিআরসির কাছে নিয়মিত রিপোর্ট করা হয়। সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে অনলাইন জুয়ার ৩৩১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

গত বছরের ৩ এপ্রিল অনলাইনে জুয়ার একটি প্ল্যাটফরমের সদস্য হাফিজ আল আসাদকে (২৩) গ্রেফতার করে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। সংস্থাটি জানায়, ওই ব্যক্তি বিভিন্ন মানুষকে টাকা ও ডলারের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া খেলার জন্য উৎসাহিত করে অংশগ্রহণ করাতেন। এতে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। হাফিজের কাছ থেকে অনলাইন জুয়া প্ল্যাটফরম পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত একটি স্মার্টফোন ও একটি সিম কার্ড জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আরও একটি সিম কার্ড জব্দ করা হয়।

এর আগে ২৭ জানুয়ারি বগুড়া সদরের কলোনি বাজারে অভিযান চালিয়ে ওয়ানএক্সবেট অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফরমের সদস্য রানা মিয়া ও রেজা আহম্মেদকে গ্রেফতার করে এটিইউ। সিআইডির সাইবার মনিটরিংয়ের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার শেখ রাজীবুল হাসান জানান, এখনো ৪০-৫০টির মতো অনলাইন জুয়ার সাইট চলমান থাকার তথ্য তারা জেনেছেন। পাবনা জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার সাঁথিয়ায় পৌর এলাকা থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় অনলাইন জুয়া বিস্তার লাভ করেছে। তরুণদের অনেকেই কৌতূহলবশত এই খেলা শুরুর পরেই নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময় খোয়াচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। বিভিন্ন নামের প্রায় ১০ থেকে ১২টির মতো অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি জুয়া খেলা হয়। এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যে কোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়। এসব অ্যাপসের বেশির ভাগই পরিচালনা করা হয় রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। এই উপজেলার গৌরীগ্রাম ইউনিয়নের এক নারী জানান, তার স্বামী অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কলহ দেখা দেওয়ার একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে বিচ্ছেদ হয়েছে তাদের।

গত বছরের ১৫ অক্টোবর রাজধানীর মুগদা থেকে রুবেল মিয়া (২৮) নামে এক যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে সময় মুগদা থানার এসআই এনামুল করিম জানান, অনলাইনে জুয়া খেলে ঋণগ্রস্ত পারিবারিক অশান্তির কারণে রুবেল তার ঘরের ভিতর থেকে ছিটকানি লাগিয়ে ফ্যানের সঙ্গে রশি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস নেয়। র‌্যাব জানায়, ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর দেশে অনলাইনে বিভিন্ন জুয়া পরিচালনার অভিযোগে একটি চক্রের ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। চক্রটি কম্পিউটার বা মোবাইল গেমের নামে অনলাইনে জুয়া পরিচালনা করে ২০০ কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে সরিয়ে নিয়েছে। গ্রেফতার জামিলুর রশিদ অনলাইন জুয়া চক্রের হোতা। তিনি চার বছর আগে উল্কা গেমস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুলে দুটি গেম ডেভেলপ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুদান পেয়েছিলেন। পরে দেশের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি জুয়া খেলার অ্যাপ ‘তিনপাত্তি গোল্ড’ বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেন জামিলুর রশিদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর