সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

পুরনো রুটেই আসছে মাদক

আলী আজম

পুরনো রুটেই আসছে মাদক

বাংলাদেশে পুরনো রুট দিয়েই আসছে মাদক। জল, স্থল ও আকাশপথে স্রোতের মতো ভারত ও মিয়ানমার থেকে এসব মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ২৫ ধরনের মাদক আসছে এসব পথে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ৩২টি জেলাকে রেডজোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ৬টি বিভাগের ৩২টি জেলার ৯৬ থানার ৩৮৬টি মাদক স্পট চিহ্নিত করা হয়। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’- এর একেবারে কেন্দ্রে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে, এর মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তদের সম্পর্কে সরকারিভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বেসরকারিভাবে দেশে ১ কোটিরও বেশি মাদকাসক্ত রয়েছেন। বছরে মাদকের পেছনে খরচ হয় আনুমানিক ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক, ব্যবসায়ী, বাহক ও বিক্রির নেটওয়ার্কে কাজ করে প্রায় ২ লাখ ব্যক্তি। প্রতি বছরই বাড়ছে এই সংখ্যা। বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। দেশের সব পুরনো রুট দিয়ে সব ধরনের মাদক প্রবেশ করছে। উঠতি বয়সী যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাদকের মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিস্তারের এ সর্বনাশা চিত্র যেভাবে আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি করছে, সেভাবে একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি করছে। কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুদের প্রচরণা, অসৎ সঙ্গ, নানা রকম হতাশা ও আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। যদিও যারা নেশা করে তারা জানে- নেশা কোনো উপকারী বা ভালো কাজ নয়। এটি মানুষের জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়। মাদকাসক্তির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে ছাত্র-ছাত্রীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে। দেশে নারীদের মধ্যেও মাদকাসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে, যা উদ্বেগের কারণ। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা পরিবার ও সমাজের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মাদকের টাকা যোগাড় করতে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ওয়াকিফহালরা বলছেন, মাদক যেন দেশের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে জোর দিতে হবে। এটি বন্ধ করতে না পারলে মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের যে জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। জানা গেছে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, টাকি, বসিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুড়িয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁ, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রাণাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্তসংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর এলাকায় মাদক ঢুকছে। আর ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীতে। এ ছাড়াও ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁর ১৭টি স্পট দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ পশ্চিম ও উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, উত্তরে আসাম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে মেঘালয় এবং পূর্বে ত্রিপুরা ও মিজোরাম দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের (বার্মা) সঙ্গে সীমানা রয়েছে। বাংলাদেশের মোট ৩২টি জেলার সঙ্গে এ দুই দেশের সীমান্ত লাইন রয়েছে। এসব সীমানার ৩৮৬ স্পট দিয়ে দেদার মাদক প্রবেশ করছে। দেশে যে পরিমাণ মাদক প্রবেশ করছে এর ৮৮ শতাংশ আসছে ভারত থেকে, মিয়ানমার থেকে আসছে ৮ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশে প্রবেশ করা মোট মাদকের ১৭ শতাংশ ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় আসছে। আর বাকি ৮৩ শতাংশ মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ঢুকছে কোটি কোটি পিস ইয়াবা। বেশির ভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান ও কাচিন প্রদেশে। মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, ধুমধুমিয়া, কক্সবাজার হাইওয়ে, উখিয়া, কাটাপাহাড়, বালুখালি, বান্দরবানের ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার মতো অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে মাদকবিরোধী অভিযানে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৩৪ হাজার ৭৭৪টি ইয়াবা ট্যাবলেট, প্রায় ১৪৩ কেজি ক্রিস্টাল মেথ (আইস), ১ লাখ ৮৫ হাজার ৮৩৩ বোতল ফেনসিডিল, ৩ লাখ ৪ হাজার ৭৪৯ বোতল বিদেশি মদ, ৯ হাজার ২৬৩ লিটার বাংলা মদ, ৫৭ হাজার ৮৯৯ ক্যান বিয়ার, ২২ হাজার ২২৯ কেজি গাঁজা, প্রায় ৩৩১ কেজি হেরোইন, প্রায় ১৩ কেজি কোকেন, ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৫৮৯টি নেশাজাতীয় ও উত্তেজক ইনজেকশন, ১ লাখ ৫৩ হাজার ২১০টি অ্যানেগ্রা বা সেনেগ্রা ট্যাবলেট, ৬৫ হাজার ৬৬৪টি ইস্কাফ সিরাপসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে র‌্যাব সর্বদা জিরো টলারেন্স। নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। সীমান্ত এলাকায় যারা মাদক ব্যবসায় জড়িত তাদের তালিকা করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায়ও যারা মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের তালিকাও করা হয়েছে। সে অনুযায়ী গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই তালিকা নিয়মিত আপডেড করা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) অতিরিক্ত ডিআইজি তানভীর মমতাজ বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান সর্বদা পরিচালনা করা হচ্ছে। অল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা থেকে দেশের অসৎ লোকেরা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। মাদক কারবারি যেই হোক তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হচ্ছে। সীমান্তে মাদক কারবারি, গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষকদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকা ধরে অভিযান চালিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দিয়ে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, মাদক একটি সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশ পুলিশ মাদক সমস্যা সমাধানে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে কাজ করে থাকে। পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্যও কাজ করে যাচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে সমাজের সব শ্রণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে, মাদকবিরোধী সমাজ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে। একটি মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।

সর্বশেষ খবর