সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

কোকেনের গন্তব্য ছিল ভারত

সাখাওয়াত কাওসার

ভয়ংকর মাদক কোকেনের গন্তব্য ছিল ভারত। কেবল রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল বাংলাদেশ। কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে পাচার হওয়া এসব চালান সর্বশেষ দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে দায়িত্ব শেষ হতো বহনকারীদের। তবে ঢাকা থেকে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য ২ হাজার ডলার করে পেতেন প্রতিজন। আবার আফ্রিকার মালাউই থেকে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসতেও বহনকারীকে দেওয়া হতো ২ হাজার ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে সাড়ে আট কেজি কোকেনের চালান জব্দের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের পর তাদের দেওয়া তথ্যে এ বিষয়টি উঠে এসেছে। বহনকারীদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াত সবকিছু বহন করত মাদক       পাচারকারীরা। আদালতের কাছে এদের সাতজন নিজেদের জড়িত থাকার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসানের আদালতে জবানবন্দিতে নাইজেরিয়ান এনডুলে ইবুকা স্ট্যানলি পোডস্কি উল্লেখ করেছেন, তিনি তিনবার অবৈধ পণ্য নিয়ে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়েছেন। সবশেষ নতুন দিল্লি লাগেজটি পৌঁছে দিতেন। এ জন্য প্রতি ট্রিপের জন্য ২ হাজার মার্কিন ডলার করে পেয়েছেন। অর্থ লেনদেনের রসিদও আছে তার কাছে। মাদকের চালানগুলো জ্যাকব ফ্র্যাঙ্ক ওরফে ডন ফ্রাঙ্কির চাচাতো ভাই ডন ওয়েসলি তাকে দিয়েছিলেন। সেগুলো রাজধানীর বারিধারা এলাকায় ডন ফ্রাঙ্কির অফিস থেকে নেওয়া হতো। জবানবন্দিতে পোডস্কি আরও উল্লেখ করেছেন, তিনি একজন নাইজেরিয়ান। ২০২০ সালে বাংলাদেশে আসার পর থেকে তিনি নাইজেরিয়া ফিরে যাননি। এখন তার পাসপোর্ট নেই। তিনি বাংলাদেশে গার্মেন্টস ব্যবসা করেন। ডন ফ্রাঙ্কিকে তিনি তিন বছর ধরে চেনেন। ডন ফ্রাঙ্কির সঙ্গে তার বারিধারা ডিওএইচএস ১১ নম্বর রোডের ৫৩১/২ হোল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার অফিস-কাম-বাসভবনে অনেকবার দেখা হয়। ডন ফ্রাঙ্কি বাংলাদেশে নাইজেরিয়ান সম্প্রদায়ের সভাপতি। ডন ফ্রাঙ্কি কোকেন নেটওয়ার্কের মূল ব্যক্তি। বাংলাদেশে তার মাদক ব্যবসার সহযোগীরা হলেন রনি, আপেল, ওস্কার, ডন ওয়েসলি।

একই দিন অর্থাৎ ৯ ফেব্রুয়ারি একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তানজানিয়ার নাগরিক মোহাম্মদী আলী মোহাম্মদ। এর আগে তিনি আদালতের নির্দেশে তদন্ত কর্মকর্তার হেফাজতে চার দিনের রিমান্ডে ছিলেন। জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন, তানজানিয়ার কারিয়াকোতে তার একটি ছোট মুদির দোকান আছে। ম্যাকডোনাল্ড নামের মালাউইর এক নাগরিকের মাধ্যমে এক বছর ধরে মালাউ থেকে পণ্য কিনতেন। ম্যাকডোনাল্ডই বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করে। বলেন, বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। সেখানে একটি লাগেজ নিয়ে গেলে ২ হাজার ডলার দেওয়া হবে। যাতায়াত ভাড়া, থাকা-খাওয়া সব ফ্রি দেওয়া হয়। সঙ্গে পকেট মানি হিসেবে ২০০ মার্কিন ডলারও দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, সে অনুযায়ী ১৩ জানুয়ারি বাসে করে মালাউই যান। ১৭ জানুয়ারি ম্যাকডোনাল্ড লাগেজ দেন এবং তার গাড়িতে করে লিলংওয়ে বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়ে আসেন। ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে আসার পর একজন হেল্প লাইনের লোক আমার কাছে এসে আমার নাম জিজ্ঞেস করে। তারপর তিনি আমাকে একটি কাগজ দেন এবং আমি তা পূরণ করে ব্যাংক কাউন্টারে জমা দিই এবং ভিসা ফির জন্য  ৫১ ডলার দিই। নিজে ট্যাক্সি নিয়ে ‘এফর্ড ইন’ নামের হোটেলে যান।  বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে ১০৬ নম্বর রুমে চেক ইন করেন। দুই ঘণ্টা পর ‘ডন ফ্রাঙ্কি’ নামের একজন তাকে ফোন করে নিচে নামতে বলেন। বলেন, তার ভাই নাম ডন উইজলি তাকে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। লিফটে নামার সময় তিনি নাইজেরিয়ান কেলভিন ইয়েঙ্গিকে দেখতে পান। বেলা ২টা ৪৭ মিনিটে তাকে গাড়িতে করে বারিধারায় নিয়ে যান ডন উইসলি। সেখানে প্রায় ৪০ মিনিট অবস্থানের পর পুনরায় তাকে উত্তরা হোটেলে নামিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় কেলভিন ইয়েঙ্গির প্যাকেটটিও তার কাছে দেওয়া হয়। কেলভিনের অনুরোধে তার প্যাকেটটি তিনি রাখতে বাধ্য হন। এর পর থেকে ওই হোটেলে অবস্থান করছিলেন তিনি। গত ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে পুলিশ ডগ স্কোয়াড নিয়ে আমার ১০৬ নম্বর রুমে অভিযান চালায়। এসব বিষয় নিয়ে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে এই সিন্ডিকেট দীর্ঘ দিন ধরেই কোকেন পাচারে জড়িত। আমাদের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত আরও কেউ থাকলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। প্রসঙ্গত, গত ২৪ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৮ কেজি কোকেন জব্দ করা হয়। এ সময় মাদক বহনের দায়ে আফ্রিকার দেশ মালাউর নাগরিক নোমথানডাজো তোয়েরা সোকো গ্রেফতার হন। পরে টানা অভিযানে আরও একাধিক নাইজেরীয় এবং একজন তানজানিয়ার নাগরিককে গ্রেফতার করে ডিএনসি।

সর্বশেষ খবর