রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

দুর্নীতি নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে স্মরণীয় উপাচার্য শিরীণ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও চবি প্রতিনিধি

দুর্নীতি নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে স্মরণীয় উপাচার্য শিরীণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভিসি হিসেবে চার বছরে নানা অনিয়ম, নিয়োগ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ সঙ্গী করে মেয়াদ শেষ করলেন অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। ৫০০ শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রথম এই নারী উপাচার্য। এ নিয়োগে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। এসব নিয়োগে মিডিয়া হিসেবে কাজ করেছেন নিজ কন্যা ও ভাতিজা। শেষ কর্মদিবসেও ৩৭ জনকে নিয়োগ দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়ে ইতি টেনেছে ভিসির চেয়ার। ১৯ মার্চ নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের। তিনি নিয়োগের বিষয়ে বলেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ হবে। যারা যোগ্য-মেধাবী তারাই নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাবেন। এ বিষয়ে জানতে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কথা বলেননি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমদের মুঠোফোনেও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। জানা যায়, ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের উপাচার্য হিসেবে চার বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়। তিনি দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে উচ্চমান সহকারী, নিম্নমান সহকারী, ঊর্ধ্বতন সহকারী, নিরাপত্তাপ্রহরী, অফিস পিয়ন, বুক বাইন্ডার, কম্পিউটার ল্যাব সহকারী, ভোজনালয় সহকারী, পেশ ইমাম, ঝাড়ুদার, পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী নিয়োগের জন্য অনুসরণ করতে হয় বেশ কিছু নিয়ম। এর মধ্যে রয়েছে শূন্যপদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, প্রার্থীদের আবেদন যাচাই, মৌখিক অথবা ব্যবহারিক পরীক্ষা, উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশের পর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কর্তৃক যাচাইবাছাই শেষে অনুমোদন। অথচ অধ্যাপক শিরীণ আখতার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দায়িত্বের শেষ দিন কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দিয়েছেন কয়েক ডজন নিয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয়সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে বিধিবহির্ভূতভাবে শতাধিক নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। অভিযোগ আছে, এসব নিয়োগে রয়েছে বড় ধরনের দেনদরবার। চট্টগ্রামের স্থানীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা এসব নিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছেন। পাশাপাশি তার গুণগান গাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক নেতাদেরও দিয়েছেন প্রাধান্য। এর আগে ২০২২ সালের ৫ মার্চ চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেট। সে সময় শিক্ষক নিয়োগে লবিংয়ের পাঁচটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারীকে বলতে শোনা যায়-শিক্ষক পদে ১৬ লাখ, তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী পদে ১২ লাখ এবং চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী পদে ৮ লাখ টাকা লাগবে নিয়োগ পেতে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের হলে ১৬ লাখ এবং চট্টগ্রামের বাইরের হলে ২০ লাখ টাকা লাগে শিক্ষক হতে। এমন চাঞ্চল্যকর অডিও ফাঁস হওয়ার পর ফারসি বিভাগের নিয়োগটি বাতিল হলেও থেমে ছিল না নিয়োগবাণিজ্য। ২০২২ সালের ৬ আগস্ট আরও দুটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। এতে দেখা যায়, নিম্নমান সহকারী পদের কর্মচারী মানিক চন্দ্র দাস নিজেকে সেকশন অফিসার পরিচয় দিয়ে তিন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করেছেন। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যদিও ২০১৮ সাল থেকে দৈনিক মজুরি কিংবা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ বন্ধ রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বরে অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁর সময়ে সিন্ডিকেটের অনুমোদনে ১৩০ জন শিক্ষক ও ২৩৮ জন কর্মচারী নিয়োগে পেয়েছেন। অন্যদিকে কোনো প্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ১১৫ ও চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ৫৭ জন। সর্বমোট ৫৪০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে গেছেন অধ্যাপক শিরীণ আখতার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য সহযোগী অধ্যাপক ড. নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব বলেন, ‘উপাচার্য বারবার বলতেন আমাদের অসংখ্য লোকের প্রয়োজন। কিন্তু ইউজিসি লোকবল দিচ্ছে না। তাই আমি লোক পাঠাচ্ছি। তখন আমরা ৫৪৫তম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে। একটি কমিটি করা হয়েছিল, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদে দেখবেন আসলেই কত লোক প্রয়োজন। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুসারে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু তিনি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত না মেনে অপ্রয়োজনীয় নিয়োগ দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ না হওয়ায় অসংখ্য মানুষ এ সুযোগ গ্রহণ বা আবেদন করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পাশাপাশি এখানে সিন্ডিকেটের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সেটিও মান্য করা হয়নি। তাই বলা যায় এসব নিয়োগ অপ্রয়োজনীয় এবং প্রশ্নবিদ্ধ।’ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক বলেন, ‘তিনি (উপাচার্য) নিশ্চিত ছিলেন তিনি আর নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে কেউ আসলে নিয়োগ দেয় না। তিনি উপাচার্যের পদ ব্যবহার করে, খাটো করে এ নিয়োগগুলো দিয়েছেন।’

সর্বশেষ খবর