সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং

দমনে ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করবে পুলিশ - তালিকা হচ্ছে ঝরে পড়া শিশু-কিশোরদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। কিশোর অপরাধীরা ঘটিয়ে চলছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিংসহ হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেম নিয়ে বিরোধ, মাদকদ্রব্যসহ নানা অপরাধে অনেক কিশোর-তরুণ নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। চরম উদ্বিগ্নতায় ভুগছেন বখে যাওয়া এসব কিশোরের অভিভাবক এবং স্বজনরাও। কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য শুরুর দিকে কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলেও এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ায় রীতিমতো চ্যালেঞ্জে পড়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তবে কিছুটা আশার খবর হলো, কিশোর অপরাধ দমনের জন্য বিশেষ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে কর্মকর্তাদের কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকগুলো প্রভাবক জড়িত থাকার কারণে ‘গ্যাং কালচার’-এর নিয়ন্ত্রণ আনতে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছে কর্তৃপক্ষ।

অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় নানাভাবে এর সুযোগ নিচ্ছে কিশোর অপরাধীরা। তবে কোমলমতি এসব কিশোরকে ব্যবহার করে ফসল ঘরে তুলছে ‘গ্যাং’-এর পৃষ্ঠপোষকরা।

জানা গেছে, গত শনিবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস অডিটরিয়ামে কিশোর গ্যাং দমনের জন্য বিশেষ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করার কথা জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। এর আগে ওপেন ফ্লোর অপশনে তেজগাঁও বিভাগের ডিসি এইচ এম আজিমুল হক বলেন, কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে আগাম ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিশু-কিশোরদের তালিকা করতে হবে। কারণ সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তানরা খুব একটা কিশোর গ্যাংয়ে জড়াচ্ছে না। তাদের সংখ্যা অনেক কম। তবে সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্ন শ্রেণির পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করেই গড়ে তোলা হচ্ছে কিশোর গ্যাং। কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান তার বক্তব্যে সব অপরাধ বিভাগের উপকমিশনারদের (ডিসি) লিখিত মতামত দেওয়ার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, পরবর্তীতে এ সংশ্লিষ্ট সেমিনারের আয়োজন করা হবে। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের ভাবনা লিপিবদ্ধ করা হবে। সর্বশেষ এ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি হবে কিশোর অপরাধ দমনের এই ফ্রেমওয়ার্ক। গত শনিবার সকালে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটরিয়াম, রাজারবাগে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় (ক্রাইম কনফারেন্স) অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিকে কিশোর গ্যাং তৎপরতা বন্ধ করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। গতকাল পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এ নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। পাশাপাশি সাইবার প্যাট্রোলিং কার্যক্রম জোরদার করতে জেলা পর্যায়ে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। সভায় অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুল ইসলাম বলেন, এলাকাভিত্তিক কিশোর অপরাধীদের চিহ্নিত করে কিশোর অপরাধ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের কোথাও গ্যাংয়ের নামে কিশোররা যাতে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য সতর্ক থাকতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি। অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) আতিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনলাইন প্ল্যাটফরমে অনুষ্ঠিত এ সভায় সব মহানগর পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপাররা অংশ নেন। পুলিশ সদর দফতরে উপস্থিত ছিলেন ডিআইজি (অপারেশনস) আনোয়ার হোসেন, ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) জয়দেব কুমার ভদ্রসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

গোয়েন্দারা বলছেন, বেশির ভাগ এলাকায়ই স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। তাদের নিজের নিরাপত্তার হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন তারা। মদদদাতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা না হলে কখনো তা নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

আটককৃতদের তথ্যে হতবাক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী : গত ১৭ মার্চ সন্ধ্যায় রাজধানীর পল্লবী সেকশন-১২ নম্বর এলাকার ১৩ নম্বর রোডে ফয়সাল (২৫) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এতে রাশেদ ওরফে রানা ওরফে রানু (২২) নামে আরেক যুবক ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে র‌্যাব-পুলিশ ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের জবানিতে উঠে এসেছে মাদক, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে দুটি গ্যাংয়ের সদস্যদের দীর্ঘদিনের বিরোধেই এ হত্যাকান্ড।

গত ২১ মার্চ রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় একটি হত্যা মামলায় জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতার এস এম ওয়াহিদ হোসেন ওরফে পুলকের জবানিতে আঁতকে উঠেছেন খোদ তদন্তসংশ্লিষ্টরা। নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে ডিএমপির ঊর্ধ্বতনদের। নিজ চাচা আফিল মিয়াকে খুনের পর পুলক তার মাকে জানিয়েছিল, একে একে চাচার পরিবারের সবাইকে (পরিবারের ৯ সদস্য) হত্যা করবে। এরপর এলাকার অন্যান্য হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দেবে। উত্তরা অপরাধ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর চেষ্টা চালাবে পুরো ঢাকার অপরাধ জগতের ডন হওয়ার। তার থাকবে গাড়ি-বাড়ি এবং লাশঘর। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই তদন্তসংশ্লিষ্টদের পুলক জানিয়েছে, তার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল দক্ষিণখানে কসাইবাড়ী থেকে উত্তরখানে কাঁচমুগা পর্যন্ত এলাকার অবৈধ অস্ত্র ও মাদকসহ অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। তাকে সবাই এক নামে চিনবে। পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কথায় উঠবে-বসবে। তার একটা লাশঘর থাকবে। যেখানে সব সময় ৪-৫টি লাশ থাকবে। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক। মানুষ হত্যাকে সে নেশায় পরিণত করতে চেয়েছিল। ইয়াবা সেবন করে সে যে ‘পিনিক’ পেয়েছে, মানুষ হত্যা করে তার চেয়ে বেশি ‘পিনিক’ পেয়েছে।

ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনা সভায় আরও যা আলোচিত হয়েছে : অপরাধ পর্যালোচনা সভায় অনলাইন জিডির (সাধারণ ডায়েরি) নানা ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা অনলাইন জিডি করতে গিয়ে আরও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও জিডি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বেশির ভাগ সময়ই সার্ভার ডাউন থাকছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো না হলে প্রয়োজনে আগের ম্যানুয়ালে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলেন তিনি।

সর্বশেষ নিজের বক্তব্যে ডিএমপি কমিশনার বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের কেউ যদি বাসাবাড়িতে, সড়কে ও যানবাহনে চাঁদাবাজি করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সম্প্রতি শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় একটি ঘটনায় তৃতীয় লিঙ্গের একজনের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তৃতীয় লিঙ্গের বিভিন্ন সদস্যের নামে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব অভিযোগের আলোকে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ডিএমপি কমিশনার বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে ডিএমপি সব ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়াও গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল, চুরি মামলা, ছিনতাই মামলা, মামলা তদন্ত, চোরাই গাড়ি উদ্ধার, মাদক উদ্ধার ও মুলতবি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। এ সময় ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) এ কে এম হাফিজ আক্তার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খঃ মহিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার, উপ-পুলিশ কমিশনার ও বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর