শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
গৃহকর্মী নির্যাতন

জীবিকার খোঁজে এসে যায় জীবন

♦ তিন বছরে মৃত্যু ৩৬ ♦ পাঁচ বছরে নির্যাতনের শিকার ১৮২

জিন্নাতুন নূর

ঢাকাসহ সারা দেশে হাতেগোনা কয়েকটি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা সামনে এলেও বেশির ভাগ ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়া হয়। আপসের মাধ্যমে অভিযুক্তরা শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যান। দেশে ২০১৫ সালে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা নীতিমালা করা হলেও সেটি কোনো আইন নয়। এ জন্য গৃহকর্মীদের বেতন, কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা, বয়স এবং নিয়োগ কোনো কিছুই আইনের আওতায় হয় না। বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, গত তিন বছরে ৩৬ জন গৃহকর্মীর নির্যাতনে মৃত্যু হয়। আর বিগত পাঁচ বছরে নির্যাতনের শিকার হয় ১৮২ জন গৃহকর্মী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নির্যাতনের মূল কারণ হচ্ছে এর কোনো বিচার হয় না। আবার গৃহকর্মীর অভিভাবকরাও দায় এড়ানোর জন্য অনেক সময় তাদের খোঁজ রাখেন না। এই অবস্থায় গৃহকর্তার নির্মমতায় প্রাণ যাচ্ছে শহরে জীবিকার খোঁজে আসা অনেক অসহায় গৃহকর্মীর। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের অষ্টম তলার ফ্ল্যাট থেকে পড়ে প্রীতি উরাং নামের এক শিশু গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়। ঘটনার পরদিন প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। মামলায় সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে ২০২৩ সালে ৬ আগস্ট আশফাকুল হকের বাসা থেকেই তার আরেক গৃহকর্মী ফেরদৌসী অষ্টম তলা থেকে পালাতে গিয়ে পড়ে আহত হওয়ার পর মামলা হলেও ফেরদৌসীর পরিবার মামলাটি থামিয়ে দেয়। ২ লাখ টাকায় ঘটনাটি মিটমাট করে ফেলা হয়। কিন্তু ফেরদৌসীর পরিবার জানায়, মেয়েটি ওই ঘটনায় আহত হয়ে এখন আর হাঁটতে পারে না।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাভারে গৃহকর্তার ‘কুপ্রস্তাবে’ রাজি না হয়ে কাজ ছেড়ে দেওয়ায় সাহেদা বেগম নামে এক গৃহকর্মীকে চুরির অপবাদ দিয়ে মারধরসহ শরীরে প্লাস ও সুই বিধিয়ে আমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে গৃহকর্তা মো. তুহিন ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, সারা দেশে এখন ২৫ লাখ গৃহকর্মী আছেন। আর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী দেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে এমন শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার। এদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছর। এদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই মেয়েশিশু। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে গত তিন বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে ৩৬ জন গৃহকর্মী তাদের গৃহস্বামীর বাসায় মারা যান। এদের মধ্যে ৯০ ভাগই নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায়। এদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করে। কেউ কেউ ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কারও রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এ সময় মোট নির্যাতনের শিকার হয় ১০৩ জন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৬৯টি। একই সংস্থার ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য বলছে, সারা দেশে এই পাঁচ বছরে ১৮২ জন গৃহকর্মী কর্মস্থলে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে দৈহিক নির্যাতনের শিকার ৭২ জন। ধর্ষণের শিকার ৩১ জন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার বেশি হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর এক জরিপে অংশ নেওয়া ২৮৭ জন গৃহশ্রমিকের ৫০ ভাগ জানিয়েছেন তারা কোনো না কোনোভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিলসের তথ্য বলছে, সারা দেশে মোট গৃহকর্মীর ৯৫ ভাগেরও বেশি নারী। গৃহকর্তার কাছে ৫০ শতাংশ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়। এদের অর্ধেকই শিশু। ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে সারা দেশে ১ হাজার ৫৬০ গৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা ও হত্যার শিকার হয়। এদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছে ৫৭৮ গৃহকর্মী। বিলস-এর গবেষণা বলছে, গৃহশ্রমিকদের মাসিক গড় আয় ৫ হাজার ৩১১ টাকা। কিন্তু তাদের পরিবারের খরচ এর দ্বিগুণের বেশি। আর এদের নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা নেই। দিনে ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। ৮৭ শতাংশের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। অসুস্থতার জন্য ছুটি পান অল্প সংখ্যক মানুষ। মজুরিসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি পান মাত্র ৭ শতাংশ। বিলস-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের মূল কারণ হচ্ছে এর কোনো বিচার হয় না। আমাদের যে সামাজিক অবক্ষয় তৈরি হয়েছে এতে মানুষ মনেই করে না যে, তার বাড়িতে ছোট যে মেয়েটি গ্রাম থেকে কাজ করতে এসেছে, তার প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা বা সহানুভূতি প্রকাশ করতে হবে। আবার গৃহশ্রমিক নিবন্ধন না থাকায় তাদের অধিকার আইন দ্বারা স্বীকৃত না। যদি আইনের স্বীকৃতি থাকত, নিবন্ধন হতো, মাঝেমধ্যে সিটি করপোরেশন বা শ্রম অধিদফতর থেকে লোকজন একটি মহল্লার দুই-তিনটি বাড়িতে গিয়ে গৃহকর্মী শিশু বা নারীদের সাক্ষাৎকার নিতেন, তাহলে এভাবে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটত না। আবার এসব গৃহকর্মীর অভিভাবকরাও অসচেতনতা এবং দায় এড়ানোর জন্য অনেক সময় এদের খোঁজখবর রাখেন না। তারা কিছু টাকা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। আবার সরকারের ওপর কোনো চাপ না থাকায় সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে আইন করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপ থাকলে হয়তো দ্রুত আইন তৈরি হতো।

সর্বশেষ খবর