সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভক্ষকের ভূমিকায় রক্ষক

নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা

ভক্ষকের ভূমিকায় রক্ষক

সুন্দরবনে নতুন পর্যটন কেন্দ্র, বাঘ গণনা, বন্যপ্রাণীর জীবনচক্র ও বনের সুরক্ষায় ক্যাম্প নির্মাণসহ একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বনবিভাগ। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতেই এই প্রকল্প, দাবি বনকর্তাদের। তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, এসব উন্নয়ন প্রকল্প সুন্দরবনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করবে। এতে সরকারি অর্থের অপচয়সহ লুটপাটও হচ্ছে। বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটন সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প’, ‘সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প’ ও ‘সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’-এর কাজে প্রকল্প প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন কর্মকর্তারা নিজেরাই। এর মধ্যে চলমান ‘সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প’র প্রকল্প কর্মকর্তা খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো ও ‘সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’র প্রকল্প কর্মকর্তা সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন। ‘সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটন সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। জানা যায়, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম ও আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক বনকর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিবেশবান্ধব পর্যটন সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে নতুন পর্যটন কেন্দ্র তৈরিতে লুটপাট নয়, করা হয়েছে পুকুরচুরি। প্রকল্পের আওতায় ফাইবার বডি ট্রলার, পাবলিক টয়লেট, পুকুর খনন, আরসিসি ফুট ট্রেইল, ইনফরমেশন সেন্টার, স্যুভেনির শপ নির্মাণ, গাইড কো-ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও লিফলেট বিতরণে অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় আয় থেকে ব্যয় মেটাতে মাঠপর্যায়ের বন কর্মকর্তাদের বাধ্য করা হয়েছে।

কালাবগিতে কমিউনিটি ট্যুরিজম চালু করতে স্থানীয় কিছু মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তাদের এ বিষয়ে আগ্রহ বা ন্যূনতম ধারণা নেই। পর্যটকদের বনের ভিতরে ঘুরতে নিয়ে যেতে যে ডিঙ্গি নৌকা দেওয়া হয়েছে তা নাজুক, সামান্য ঢেউয়ে ডুবে যায়। পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে পরিবেশবান্ধব বলা হলেও বনের মধ্যে আরসিসি ফুট ট্রেইল, বন্যপ্রাণী রাখার সেড ও ওয়াচ টাওয়ার করতে কাটা হয়েছে অসংখ্য গাছ। যা ইকোসিস্টেম হুমকিতে ফেলেছে। এ ছাড়া বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার, বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) নবায়ন ও অনুমতিপত্র দিতে কয়েক গুণ বেশি অর্থ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা বেগম বলেন, সুন্দরবনে পর্যটনব্যবস্থা গড়তে গাছ কেটে কংক্রিটের রাস্তা, টাওয়ার ও স্থাপনা নির্মাণ কোনো অবস্থাতে বনের পরিবেশবান্ধব নয়। বরং জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। পরিবেশবিদরা বলছেন, সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তারা বন রক্ষায় যতটা না যত্নশীল তার চেয়ে বেশি আগ্রহী লাভজনক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প বনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করবে। কল্যাণ বয়ে আনবে না। এদিকে গত দুই মাসে বনের প্রান্তসীমা ৪ কিলোমিটারের মধ্যে দাকোপ, চিলা, চাঁদপাই, মুন্সীগঞ্জে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যক্তিগত অনেক ‘ইকো কটেজ’ গড়ে উঠেছে। বন আইন লঙ্ঘন করে বিনোদন কটেজ নির্মাণ হলেও অজ্ঞাত কারণে বনবিভাগ বাধা দেয়নি। ট্যুর অপারেটর অব সুন্দরবন (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আজম ডেভিড বলেন, সুন্দরবন ঘেঁষে ‘ইকো কটেজ’ নামে যে বিনোদন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে তা আশপাশের জনবসতি ঘিরে নতুন সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি ইকো কটেজের আলোর ঝলকানি, উচ্চমাত্রার শব্দ বনের প্রাণীকুলের ওপর চাপ তৈরি করছে।

বিষদস্যু ও বনবিভাগ আঁতাত : প্রতি বছর জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে বনে মাছধরা নিষিদ্ধ থাকে। বনজীবী স্থানীয় মহাজন ও জেলে এই নিষিদ্ধ সময়কে বেছে নেয় বিষ দিয়ে মাছ ধরার জন্য। তারা খালের পানিতে কীটনাশক মিশিয়ে মাছ ধরে লোকালয়ে বিক্রি করে। আবার অনেকে বনের মধ্যেই খটি বা মাচা (মাছ শুকানোর ঘর) তৈরি করে আগুনে ছেঁকে শুঁটকি তৈরি করে। এসব খটিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় বনের গাছ। অর্থের বিনিময়ে বন কর্মকর্তারা এসব কাজে সহায়তা করে। জানা যায়, কয়রায় কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন এলাকায় ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট বিনাপানি স্লুইস গেট এলাকা থেকে ৫২০ কেজি, ৮ আগস্ট কয়রায় শাকবাড়িয়া নদীর তীর থেকে ২০০ কেজি, ৭ আগস্ট বেদকাশী থেকে ৫০ কেজি, ৬ আগস্ট দেউলিয়া বাজার থেকে ১৩০ কেজি, ১৯ জুলাই ৩১০ কেজি বিষ দিয়ে ধরা চিংড়ি মাছ আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ২২ আগস্ট হরিণের মাথা ও ১৯ জুলাই ৫৩ কেজি হরিণের মাংস আটক হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ফরেস্ট স্টেশনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। উপরন্তু, এই চক্রের সঙ্গে কাশিয়াবাদ স্টেশনের এসও শ্যামা প্রসাদ রায়ের সম্পৃক্ততা নিয়েও কয়রা উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট নিয়েছেন ৯৭৫ জন জেলে। চলতি অর্থবছরে তা নবায়ন করতে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি আদায় করা হয়।

বনকর্মী ও চোরা শিকারি যোগসাজশ : সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ হয়নি। অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্থের বিনিময়ে বন্যপ্রাণী হত্যায় সুযোগ দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে অভিযানে হরিণের মাংস জব্দ হলে কাগজপত্রে সামান্য কিছু উল্লেখ করে বাকিটা গায়েব করছে বনরক্ষকরাই। শিকারিদের মামলা থেকে রক্ষায় তদবিরের অভিযোগও রয়েছে বনকর্তাদের বিরুদ্ধে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চোরা শিকারিদের যোগসাজশের প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে কয়রায় জব্দ হওয়া ১২০ কেজি হরিণের মাংসের মধ্যে ৯৫ কেজিই গায়েব করেন বনকর্মীরা। তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক কাজী মোস্তাক আহম্মদ বলেন, হরিণের মাংশকান্ডে জড়িতদের রক্ষায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে বন বিভাগের চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, পরিবেশগত দিক যাচাই-বাছাই করেই বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হয়নি। চোরা শিকারি ও বিষ দিয়ে মাছ ধরায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইকো কটেজের বিষয়টি নজরে এসেছে। বনের ক্ষতি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর