মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা
বেপরোয়া চাঁদাবাজ

পরিবহনে স্তরে স্তরে চাঁদাবাজি

♦ মাসে চাঁদাবাজি শত কোটি টাকা ♦ মালিক শ্রমিক পুলিশসহ রাজনৈতিক নেতা জড়িত

শামীম আহমেদ ও হাসান ইমন

পরিবহনে স্তরে স্তরে চাঁদাবাজি

কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বাগমারা বাজার থেকে নাঙ্গলকোট উপজেলার বাঙ্গড্ডা বাজার সড়কে সিএনজি অটোরিকশা চালান মো. ইবরাহীম। এ সড়কের মধ্যবর্তী স্থান ভুশ্চি বাজারের ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে প্রতিদিন তাকে ৩০ টাকা দিয়ে টোকেন নিতে হয়। টাকা না দিলে এ সড়কে গাড়ি চালানো বন্ধ। শুধু ভুশ্চি বাজার নয়, জেলার লাকসাম বাইপাস, নাথের পেটুয়া, নাঙ্গলকোট, বাগমারা, লালমাই, বরুড়া, পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বাজার এলাকায় গাড়ি নিয়ে ঢুকতে চাঁদা দিয়ে নিতে হয় পৃথক টোকেন। ইবরাহীম বলেন, ‘আবার ঘুরে এসে দিচ্ছি এমন আবদারও টেকে না। আগের দিনের আয় থেকেই চাঁদার টাকা রেখে দিতে হয়।’ রাজধানীর চকবাজার থেকে সিএনজিতে যাত্রী তুললে দিতে হয় ৫০ টাকা। এজন্য সেখানকার প্রতিটি সিএনজি স্টেশনে রয়েছে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের নিয়োগ দেওয়া পৃথক লাইনম্যান। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ গাড়ি চলাচল করে। প্রতি ট্রিপে চাঁদা দিতে হয় ৮০০ করে। সীমাহীন চাঁদাবাজি চলছে দেশের পরিবহন সেক্টরে। সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, পায়ে চালানো রিকশা, পিকআপ, বাস, টেম্পো কোনো কিছু নেই চাঁদার বাইরে। চাঁদা দিলেই কেবল ঘোরে গাড়ির চাকা। বিষয়টি বছরের পর বছর বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় বহালেও বন্ধে নেই উদ্যোগ। পরিবহনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যারা চাঁদাবাজি বন্ধে উদ্যোগ নেবেন, তারাই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদার ভাগ চলে যায় সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর শীর্ষ মহল পর্যন্ত। এ কারণেই চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না। আর পরিবহনে চাঁদাবাজির কারণে ব্যক্তি খাতে যাতায়াতে খরচের পাশাপাশি বাড়ছে পণ্যমূল্যও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহনে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জরিপে পরিবহন খাতে ৪৬ ভাগ সেবাগ্রহীতাকে চাঁদা দিতে হয় এমন তথ্য উঠে এলেও বাস্তবে ৯০ ভাগ সেবাগ্রহীতাকেই চাঁদা দিতে হয়। ভয়ে অনেকে মুখ খোলেন না।

চাঁদার হার : প্রতি মাসে পরিবহন খাত থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় হচ্ছে। যানবাহনভেদে দৈনিক ২০ টাকা থেকে হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন চৌরাস্তায় প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা করে চাঁদা আদায় করে একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। একই সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা লালবাগ চাপড়া মসজিদ থেকে কামরাঙ্গীর চর পর্যন্ত প্রতিদিন ৪০০ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। এদের থেকে প্রতিদিন ৫০ করে ২০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় হয়। শুধু এ দুই জায়গায় নয়, সারা দেশে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, লেগুনা, বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ অন্যান্য পরিবহন থেকে শত কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়।

যাদের দিতে হয় চাঁদা : সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি স্ট্যান্ড ঘিরে রয়েছে শ্রমিক সমিতি কিংবা মালিক সমিতির নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠন। আর এগুলোর নেতৃত্বে থাকছেন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালীরা। এদের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট। আবার প্রতিটি স্ট্যান্ডেই রয়েছে সিন্ডিকেটের নিয়োগপ্রাপ্ত লাইনম্যান। সিএনজি, অটোরিকশা, বাস কিংবা ট্রাক থেকে ওই লাইনম্যানের হাতেই নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদার টাকা আদায় হচ্ছে প্রতিদিন। বিভিন্ন রুটে গাড়ি চালাতে পুলিশকেও নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতে হয় বলে জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজিগুলো পুলিশের সঙ্গে চুক্তি করে সড়কে অহরহ চলছে। শুধু ঢাকায় চলছে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ আশপাশ জেলার ১৫ হাজার মিটারবিহীন সিএনজি অটোরিকশা। একটি দালাল চক্র ও পুলিশের সঙ্গে মাসিক ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা চুক্তিতে এ গাড়িগুলো চলাচল করে। হাই কোর্টের রায় অমান্য করে ঢাকা মহানগরীতে চলছে মিটারবিহীন সিএনজি অটোরিকশাগুলো।

যেসব খাতে চাঁদা : এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় ঢুকতে এবং বেরোতে চাঁদা, টার্মিনালে চাঁদা, টার্মিনাল থেকে বেরোতে চাঁদা, মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা, ট্রাকস্ট্যান্ডে চাঁদা, মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চালাতে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা, কাগজপত্র ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি অবৈধভাবে চলার অনুমতি নিতে চাঁদা, ট্রাকে পণ্যের ধরনের ওপর ভিত্তি করে চাঁদা, জেলা শহরে কাগজপত্র ও লাইসেন্সবিহীন শত শত গাড়ি থেকে চাঁদা, রাজধানীতে বিভিন্ন মার্কেটের সামনে থেকে যাত্রী তুলতে চাঁদা দিতে হচ্ছে যানবাহনকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন চৌরাস্তায় প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। একই সঙ্গে ইত্তেফাক মোড় থেকে মানিকনগর পাওয়ার হাউস, মিরপুর ১২ ইস্টার্ন হাউস থেকে মিরপুর সাড়ে ১১, মিরপুর সাড়ে ১১ থেকে রূপনগর আবাসিক, রায়েরবাজার থেকে ধানমন্ডির শঙ্কর, মিরপুর ১০ থেকে ভাসানটেক, ডেমরা স্টাফকোয়ার্টার থেকে মেরাদিয়া সড়কে প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। প্রতিদিন সিএনজি অটোরিকশা থেকে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। একই সঙ্গে মাসিক ২ হাজার টাকার বিনিময়ে স্টিকার দিয়ে পোস্তগোলায় সিএনজি অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি, ভুয়া রেজিস্ট্রেশন (২৯৭৮) দিয়ে ঢাকা জেলা সিএনজি, অটোরিকশা, মিশুক চালক ও শ্রমিক ইউনিয়ন নামে আইডি কার্ড দিয়ে চাঁদা আদায় করছে একটি চক্র। এ চক্রের মূলহোতা কথিত সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন দুলাল। তিনি সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকদের পরিচয়পত্র বিক্রি ও কমিটি অনুমোদন দিয়ে চাঁদাবাজি করছেন।

এ ছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে পোস্তগোলা থেকে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবাটি, বউবাজার থেকে শনিরআখড়া, ধোলাইপাড় থেকে শনিরআখড়া, জুরাইন মেডিকেল রোড, বিক্রমপুর প্লাজা থেকে ২৪ ফুট, লালবাগ চাপড়া মসজিদ থেকে কামরাঙ্গীর চর পর্যন্ত প্রতিদিন কয়েক হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। শুধু ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা ফোরস্ট্রোক অটোরিকশা সিএনজি ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সিনিয়র সহসভাপতি মো. ওমর ফারুক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে স্টিকার লাগিয়ে মাসে ২ হাজার টাকা করে চাঁদা ওঠায় একটি চক্র। একই সঙ্গে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা, মিরপুর-১০, ভাসানটেক, রূপনগর আবাসিক এলাকা, রায়েরবাজার, ডেমরাসহ ঢাকার অনেক স্পট থেকে প্রতিদিন ১০০-২০০ টাকা আদায় করছে চাঁদাবাজ চক্র। এসব এলাকা থেকে প্রতিদিন অর্ধ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। বিভিন্ন সময় পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েছি কোনো সুফল আমরা পাইনি।’

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শিমরাইল, কাঁচপুর, মদনপুর ও ডেমরা স্টাফকোয়ার্টার এলাকায় ছোটবড় সব যাত্রীবাহী পরিবহন থেকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী থেকে যাত্রীবাহী বাস ঢাকায় আসতে প্রতি ট্রিপে দেড়-দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে কৌশল বদলে এখন টোকেনে চলছে চাঁদাবাজি। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, কুমিল্লা, ফেনীসহ অন্তত ১০ স্থানে টোকেন চুক্তির মাধ্যমে চলে পরিবহন। আর চুক্তির আওতায় না থাকলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয় চালকদের। গাড়ির কাগজ ঠিক থাকার পরও গুনতে হয় দ্বিগুণ টাকা। বারবার অভিযোগ করেও মিলছে না সুফল।

অভিযোগ পাওয়া যায়, বাসগুলো যেসব জেলা পেরিয়ে আসতে হয় সেসব জেলায় মাসিক ভিত্তিতে পুলিশ সার্জেন্টদের ৫০০ টাকা করে বখরা দেওয়াও বাধ্যতামূলক রয়েছে। এর বাইরে থানা-ফাঁড়ি পুলিশকেও নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে তোলা নানা সমিতি ও সংগঠনকেও চাঁদা দিতে হয়। একই সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ সদস্য ও পরিবহন শ্রমিকরা মিলেই সারা দেশে পৃথকভাবে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। পরস্পর যোগসাজশে কৌশলে সড়ক-মহাসড়কে চলছে টাকার খেলা। সার্বিক বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন) শ্যামল কুমার মুখার্জী বলেন, ‘চাঁদাবাজির শিকার ব্যক্তিদের থানায় এসে অভিযোগ দিতে হবে। আমরা এমন অভিযোগ পাচ্ছি এবং ব্যবস্থা নিচ্ছি। হাইওয়েতে যেন চাঁদাবাজি না হয় সে বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা সতর্ক রয়েছেন। হাইওয়ে পুলিশের কোনো সদস্য যেন চাঁদাবাজির সঙ্গে না জড়িয়ে পড়েন সেজন্য তাদের শরীরে বডিওন ক্যামেরা রয়েছে। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বডিওন ক্যামেরার কারণে তারা অপরাধে জড়ানোর সাহসই পাবেন না।’

নিয়ন্ত্রণ করা হবে কঠোরভাবে

 

সর্বশেষ খবর