মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ধীরগতি

♦ মোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ১২২৩ মেগাওয়াট ♦ সৌরবিদ্যুতে ৯৮৮ বায়ুতে ৩ ও জলবিদ্যুতে ২৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন ♦ অকৃষি জমির স্বল্পতা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা বিনিয়োগের অভাব নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে বাধা

জিন্নাতুন নূর

জার্মানির সূর্যালোক বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেক। এর পরও দেশটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিয়ে দৈনিক ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সৌরশক্তিসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করছে। আর বাংলাদেশ সূর্যালোক পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশ থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট এবং জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সম্প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশ সংকটে পড়তে হয় সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগকে। এ অবস্থায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা বেশ ধীরগতির। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক ১ হাজার ১০৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি সই হয়। এর মধ্যে মাত্র ১০টি কেন্দ্র চালু হয়েছে। যার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ৪৫৯ মেগাওয়াট। অথচ একই সময়ে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার ৮৪৫ মেগাওয়াট; যা প্রায় ৪৬ গুণ বেশি।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্যে, বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোট ১ হাজার ২২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ ৯৮৯, বায়ুবিদ্যুৎ থেকে ২ দশমিক ৯, জলবিদ্যুৎ থেকে ২৩০, বায়োগ্যাস থেকে শূন্য দশমিক ৬৯ ও বায়োম্যাস থেকে শূন্য দশমিক ৪ মেগাওয়াট।

যদিও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে অন্তত ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক ১৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। এগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ৬৪৫ মেগাওয়াট। আর কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজের অগ্রগতি নিয়ে শঙ্কা আছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এগুলো উৎপাদনে আসতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। এর বাইরে চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন ২৩টি প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৪০৪ মেগাওয়াট।

স্রেডার তথ্যে, কৃষিতে সেচের জন্য দেশে প্রায় ৪ হাজার সৌরবিদ্যুৎ-চালিত সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় ৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া ৫০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ করছে বাংলাদেশ ও চীন। যৌথ অংশীদারিতে নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্র সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্কের কাজ প্রায় শেষ। সরকার দেশের উত্তরাঞ্চলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াচ্ছে। এজন্য সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুড়িগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে অনাবাদি জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে সোলার পার্ক। বায়ু ও অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ নিয়ে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণে আগ্রহী। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় বিদ্যুৎ বিভাগ অফশোর বায়ুর সম্ভাব্যতা যাচাই নিয়ে কাজ করছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ অফশোর বায়ুবিদ্যুৎ নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। আবার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঢাকার আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে লক্ষ্যমাত্রা তা সরকার বেশ ধীরগতিতে অর্জন করছে। ২০১৬ সালের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার অন্তত ১০ শতাংশ (২ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াট) নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করার কথা। কিন্তুদুই বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মাত্র ৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে হতে হবে। যদিও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আরও ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরকারের এখন পরিকল্পনা ২০৪১ সালের মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। সে সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার মেগাওয়াট। এ হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের যে পরিমাণ এবং এ খাতে নির্মাণাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের যে অগ্রগতি তা সন্তোষজনক নয়। মূলত অকৃষি জমির স্বল্পতা, প্রযুক্তিগত নানা সীমাবদ্ধতা এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাবেই বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার খুব একটা হচ্ছে না। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেন, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ১২ হাজার ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যক্রম বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে অকৃষি জমির প্রাপ্যতা অন্যতম প্রধান সমস্যা। প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমির অভাব একটি বড় বাধা। আর বর্জ্য থেকে জ্বালানি এবং বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ব্যাপক বিনিয়োগ প্রয়োজন। নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়াও চলমান। তবে প্রতিমন্ত্রী আশা করছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা হবে। তিনি আরও জানান, সৌর প্রকল্পগুলোয় দ্রুত সাফল্য পেতে প্রয়োজন প্রযুক্তি ও অর্থায়ন। সোলার রুফটপ ও ভাসমান সোলার প্রকল্পের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত হয়েছে। সোলারের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য রোডম্যাপ প্রণয়ন করে সে অনুযায়ী কাজ করা হবে। কৃষিকে মাথায় রেখে সোলার কীভাবে বাড়ানো যায়, লেক, নদী ও জলাশয়ে সোলার স্থাপন করা যায় কি না সে ব্যাপারে কাজ হচ্ছে। শহরেও সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর তিনি জোর দেন।

সর্বশেষ খবর