শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

গরম সঙ্গে নিয়ে এসেছে লোডশেডিং

♦ গ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না ♦ এবারও পুরো গ্রীষ্মকাল ভুগবে গ্রাহক

জিন্নাতুন নূর

গ্রীষ্মকাল এবারও তার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে লোডশেডিংকে। এপ্রিলের শুরুতেই সারা দেশে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং ছাড়িয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকায় লোডশেডিং পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো হলেও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহরে লোডশেডিং পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। পুরো দেশে এখন দিনে-রাতে গড়ে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকার বাইরে কোনো কোনো এলাকায় দিনে-রাতে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা যায়, আসছে দিনগুলোতে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বরং এবার গ্রীষ্মে লোডশেডিং গত গ্রীষ্মের চেয়ে খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে লোডশেডিং পরিস্থিতি এখন পুরোই ‘প্রকৃতিনির্ভর’। গরম বাড়লে লোডশেডিং বাড়ে আবার গরম কমলে লোডশেডিংও নিয়ন্ত্রণে থাকে।

দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এর তথ্যে, গত ৩ এপ্রিল রাত ১২টায় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ১২ হাজার ৫৭৭ মেগাওয়াট। আর চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয় ১৫২০ মেগাওয়াটের। এর আগে ২ এপ্রিল দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ১২ হাজার ৪৮৮ মেগাওয়াট। এদিন চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের। লোডশেডিং হয় ১৮২৬ মেগাওয়াট। দেশে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন বন্ধ আছে। সক্ষমতার অধের্কেরও কম উৎপাদন করছে অনেক কেন্দ্র। ডলার সংকটে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতির উত্তাপ।

গ্রামের তুলনায় এখন রাজধানী ঢাকায় লোডশেডিং কিছুটা কম হলেও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, দিনে-রাতে হঠাৎ করে ১০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টার মতো লোডশেডিং হচ্ছে। রমজান মাসে ইফতার ও সাহরিতে লোডশেডিং হওয়ায় দুর্ভোগে পড়ছেন গ্রাহকরা। মিরপুর-১২ নম্বর এলাকার ডেসকোর গ্রাহক শরিফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে দিনে-রাতে হঠাৎ করে কয়েক মিনিটের জন্য লোডশেডিং হচ্ছে। গত বছরও গ্রীষ্মে লোডশেডিংয়ের কারণে ভুগতে হয়েছে। এবারও নাকি গরম বেশি পড়বে তাহলে লোডশেডিংও বেশি হবে বলে ধরে নিচ্ছি। জানা যায়, ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও কারিগরি কারণে কিছু এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে।

পিডিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। দেশের বেজলোড বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো সেভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না। অথচ প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। আপাতত কোনো নাটকীয় পরিবর্তন ছাড়া এবার গ্রীষ্মে লোডশেডিং পরিস্থিতির কোনো সমাধান নেই। আবার অদূর ভবিষ্যতেও যে লোডশেডিং পরিস্থিতি ভালো হবে এমন নয়। কারণ দিন দিন গ্যাসের উৎপাদন কমছে। আবার বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে লোডশেডিং পরিস্থিতি আসছে দিনগুলোতে কমে যাবে এ ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। বরং আশঙ্কা করা হচ্ছে- এবার গ্রীষ্মে লোডশেডিং গত বছরের চেয়ে হয়তো বৃদ্ধি পাবে। তবে ঢাকার বাইরে লোডশেডিংয়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। দিনে-রাতে এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। একবার বিদ্যুৎ গিয়ে আসে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর। গরম পড়তেই চট্টগ্রামজুড়ে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ লোডশেডিং। দিনে কম হলেও ইফতারের পর থেকে বাড়তে থাকে বিদ্যুতের ভেলকিবাজি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গরম বাড়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে বিদ্যুতের উৎপাদন। যার কারণে লোশেডিং করা ছাড়া উপায় নেই আমাদের। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমাদের চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু পিসিজিবি লাইনে সংস্কার কাজ করার কারণে চট্টগ্রামে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও লোডশেডিং হচ্ছে। এ ছাড়াও দিনে গরমের তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামে উৎপাদন ভালো হলেও মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত পিসিজিবি জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ মেঘনা ঘাটে চলে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে গত বুধবার ভোর ৪টা থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। ইফতারের পর থেকে সাহরি পর্যন্ত তিন-চারবার লোডশেডিং ছিল। এ ছাড়া রংপুরে এখন দিনে-রাতে বেশ কয়েকবার লোডশেডিং হচ্ছে। একবার লোডশেডিং হলে এক ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকছে না। বিশেষ করে রংপুরের পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা বেশি ভুগছেন। ১০০ থেকে দেড় শ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। রংপুর বিভাগে এখন দৈনিক ৮০০ থেকে ৮৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে ৭০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ। আগামী মে মাসে রংপুরে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ১২০০ মেগাওয়াটে অর্থাৎ সে সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। গাইবান্ধা শহরে এখন দিনে-রাতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। একবার বিদ্যুৎ গেলে আধা ঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট পর আসছে। তবে গাইবান্ধার গ্রামাঞ্চলে দিনে-রাতে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। গাইবান্ধার ঘাগোয়া ইউনিয়নের কাঠিহাড়া গ্রামে দিনের বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকছে না। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গ্যাস সরবরাহের কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গ্যাসে ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা থাকলেও ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। তিনি আশা করছেন দুই দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম ও রংপুর এবং গাইবান্ধা প্রতিনিধি)

সর্বশেষ খবর