মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

বেপরোয়া গতিতে মৃত্যুর মিছিল

আলী আজম

বেপরোয়া গতিতে মৃত্যুর মিছিল

গত পয়লা এপ্রিল ফরিদপুরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। মেহেরপুরে নিহত হন দুই সাইকেল আরোহী। ঝিনাইদহে কলেজ শিক্ষক, নেত্রকোনায় যুবক ও সিরাজগঞ্জে পথচারীসহ সাতজনের মৃত্যু ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনার এমন দৃশ্য এখন গোটা দেশের। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের হার যেন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে পড়ছে বহু তাজা প্রাণ। মারণফাঁদ এখন রাজপথ। ঘর থেকে বের হয়ে গন্তব্যস্থলে না পৌঁছে লাশ হয়ে ঘরে ফিরছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, যান্ত্রিক ত্রুটি, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন, গাড়ির প্রতিযোগিতা, রাস্তার দুরবস্থাসহ নানাবিধ কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এসব দুর্ঘটনায় হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে পঙ্গুত্ব বরণ করা অসংখ্য মানুষ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার। সড়কের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা দুর্ঘটনার জন্য নানা কারণ নির্দিষ্ট করেছেন। তারা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাধারণত ফুটপাত দখল, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, বেপরোয়া ও হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও যানবাহনের ত্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জেব্রা ক্রসিং না থাকা এবং জেব্রা ক্রসিং গাড়িচালক কর্তৃক না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করে কথা বলা, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যান একই সঙ্গে চলাচল, সড়কের ধারে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকা , সড়কের নকশায় ত্রুটি, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতার অভাব ও পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, মাদকসেবন করে যানবাহন চালানো এবং মহাসড়ক ক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন উঠে যাওয়াই দায়ী।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, সড়ক দুর্ঘটনাসহ সার্বিক ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে নানা বিষয় জড়িত। এর মধ্যে কেবল ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট বা আইন বাস্তবায়নের অংশটিতে অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে পুলিশ। দুর্ঘটনাপ্রবণ যানবাহন, লাইসেন্সধারী ও লাইসেন্সবিহীন বেপরোয়া চালক, ড্রাইভার ও পথচারীদের আইন না মানার প্রবণতা ইত্যাদি বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়কে বিশৃঙ্খলার পেছনে অনেকাংশে দায়ী। বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে এবং সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পেশাদারিত্বের সঙ্গে আইনের নিরিখে দায়িত্ব পালন করে থাকে। পাশাপাশি মানুষকে নানাভাবে সচেতন করতে ও আইন মানতে উদ্বুদ্ধ করতে পুলিশের নানামুখী দৃশ্যমান কর্মসূচি রয়েছে। এ ছাড়া হাইওয়েতে স্পিড নিয়ন্ত্রণে স্পিডগান ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে পুলিশ। ব্র্যাক ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৯টি জাতীয় মহাসড়কের ৫৭ কিলোমিটারের মধ্যেই ৯৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। এসব মহাসড়কে ব্ল্যাক স্পট রয়েছে ২০৮টি। এসব স্পটে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে সেগুলোর ৩৮ শতাংশই বাসের কারণে। এ ক্ষেত্রে চালকদের ভুল ও অদক্ষতাকে দায়ী করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বেপরোয়া গাড়ি চালানোকে। তবে চালকরা বলছেন, যত্রতত্র বাজার ও পথচারীদের অসাবধানতাই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সড়কের ওপর বাসস্ট্যান্ড ও বাজারগুলোর কারণেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপাতত দৃষ্টিতে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে মনে হলেও আসলে কমছে না। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যান বলছে, এবারের ঈদে ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ গ্রামে যাবে। ২০২৩ সালে ঈদুল ফিতরে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছে ৩২৮ জন ও আহত হয়েছে ৫৬৫ জন। এর আগের বছর ২০২২ সালে ঈদুল ফিতরে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪১৬ জন ও আহত হয়েছে ৮৪৪ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঈদ বা যে কোনো উৎসবে সড়ক দুর্ঘটনার হার আরও বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যাও। এটি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়। পবিত্র ঈদুল ফিতরসহ সবসময় সব সড়ক ব্যবহারকারী যাতে নিরাপদে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন, সে লক্ষ্যে সরকারের প্রতি সাত সুপারিশ উত্থাপন করেছে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন। সেগুলো হচ্ছে- ১. সড়কে দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ হলো যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত গতি। সড়ক ও পরিবহনের ধরন অনুযায়ী গতি নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গাইডলাইন অতিসত্বর প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। ২. মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী উভয়েরই মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে এ-সংক্রান্ত এনফোর্সমেন্ট গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। ৩. যানবাহনে চালকসহ সব যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার সংক্রান্ত গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি মোটরযানে শিশু সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় এনে শিশুদের জন্য উপযুক্ত শিশু সুরক্ষিত আসন ব্যবস্থা প্রচলন সংক্রান্ত বিধিবিধান জারি করতে হবে। ৪. মদ্যপ অবস্থায় বা নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে মোটরযান পরিচালনা না করা সংক্রান্ত বিধিবিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। যাতে করে কেউ মদ্যপ অবস্থায় মোটরযান চালিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা না ঘটায়। ৫. সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য নিয়ে যেহেতু বিভ্রান্তি রয়েছে সেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রদানে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনাগুলো বিবেচনায় এনে কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ৬. যেহেতু বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে সড়ক ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা বিষয়টি অনুপস্থিত, সেহেতু বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের আদলে সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ৭. পরিশেষে, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস এবং এ-সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে সড়ক নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় সাধনের জন্য একটি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, ঈদের সময় সড়কে অনেক বেশি গাড়ির চাপ থাকে। তাই এ সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অর্ধেকের বেশি মোটরসাইকেলে হয়। তাই ঈদে সবাইকে মোটরসাইকেলে যাতায়াত না করার অনুরোধ করেন তিনি। আমরা আমাদের পুলিশ সদস্যদেরও নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়া নিষেধ করেছি।

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রাকে নির্বিঘ্ন ও স্বস্তিদায়ক করতে দেশের সব মহাসড়কে পুলিশের সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে জেলা পুলিশ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ইউনিট একসঙ্গে কাজ করছে। ঈদে মানুষের বাড়ি ফেরাকে আনন্দময় করতে আমরা সবাই মাঠে আছি। ঈদের ছুটি শেষ হওয়া পর্যন্ত এটা অব্যাহত থাকবে। প্রযুক্তি আমাদের সেবার মান উন্নত করেছে, আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। এজন্য এবারও আমরা বডিওর্ন ক্যামেরা, ড্রোন ক্যামেরা ও সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করছি। বিশেষ করে যেখানে যানজটের সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে আমাদের ড্রোন থাকবে। ড্রোনের মাধ্যমে আমরা ট্রাফিক নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করব। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইকসহ এ ধরনের গাড়ি চলাচল করেছে। ছোট ছোট রাস্তা থেকে দ্রুত গতিতে এসব গাড়ি মহাসড়কে উঠে পড়ছে। এগুলোই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে প্রায় অর্ধ কোটি রেজিস্ট্রার গাড়ি রয়েছে। রেজিস্ট্রারবিহীন গাড়ি রয়েছে অসংখ্য। দেশে পরিবহন ব্যবস্থা উল্টো পিরামিড গতিতে চলছে। পর্যাপ্ত গাড়ির ফলে যানজট, দুর্ঘটনা, জনজট, প্রাণহানি, জ্বালানি খরচ, যাতায়াত ব্যয় বেড়েই চলছে। পর্যাপ্ত যানবাহনের লাগাম এখনই টানতে হবে। গণপরিবহননির্ভর হতে হবে। দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করলে চলবে না। মালিক-শ্রমিক, পুলিশ ও বিআরটিএ যৌথভাবে দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্ঘটনা রোধে সবার সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর