মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

বর্ণিল আয়োজনে বর্ষবরণ

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

বর্ণিল আয়োজনে বর্ষবরণ

ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা ছবি : রোহেত রাজীব

পয়লা বৈশাখ শুধু বঙ্গাব্দের প্রথম মাসের প্রথম দিনই নয়, এটি বাঙালির চেতনার প্রদীপ। বাঙালির জাতিসত্তার পরিচায়কও বৈশাখ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পয়লা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। আর তাই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গোটা জাতি মেতে উঠেছিল বৈশাখী উন্মাদনায়। হালখাতায় পুরনো দিনের হিসাব চুকিয়ে নতুন বছরকে বরণে অন্যরকম আয়োজন ছিল দেশজুড়ে। আবহমান বাংলার মেঠোপথ থেকে গঞ্জে ও হাটে লোকজ পণ্যের পসরায় যেভাবে ফুটে উঠেছিল বাঙালির নিজস্বতা ঠিক তেমনি শহর ও নগরীর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দৃশ্যমান ছিল বৈশাখী উন্মাদনা। সারা দেশের মতো রাজধানীজুড়েও ছিল বৈশাখী উল্লাস। আবহমান বাংলার পান্তা ইলিশ, খই, মুড়ি, মুড়কি, হাওয়াই মিঠাই, নানা রকমের পিঠা আর বাতাসাসহ মুখরোচক খাবারের পাশাপাশি পোশাকেও ছিল বৈশাখের ক্যানভাস। লাল-সাদা শাড়ির সঙ্গে মাথায় ফুলের টায়রা, খোঁপায় হলুদ গাঁদায় তরুণীরা যেভাবে বৈশাখকে স্বাগত জানিয়েছিল ঠিক তেমনি বাহারি রং ও বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের পাঞ্জাবিতে তরুণরাও মেতেছিল পয়লা বৈশাখের উন্মাদনায়। মঙ্গল শোভাযাত্রা, নাচ, গান, লাঠিখেলা, রায়বেশে নৃত্য, সংযাত্রা, গম্ভীরা গান, পুঁথিপাঠসহ নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাঙালির সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসবে রাজধানীতেও উৎসবের রং ছড়িয়েছিল সংস্কৃতিকর্মীরা। নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পয়লা বৈশাখ উদযাপন করেছে উৎসব আর উদ্দীপনায়।

ছায়ানট : নাচ, গান, আবৃত্তি ও পাঠসহ নানা আয়োজনে রমনার বটমূলে নববর্ষ ১৪৩১-কে স্বাগত জানিয়েছে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। পয়লা বৈশাখের ভোরে শিল্পী মর্তুজা কবির মুরাদের বাঁশিতে আহীর ভৈরব রাগ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির এবারের প্রভাতি আয়োজন। নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতি, মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর আত্মবোধন-জাগরণের ১১টি সম্মেলক গান, ১৫টি একক গান এবং পাঠ ও আবৃত্তিতে সাজানো ছিল বর্ষবরণের এবারের আয়োজন। গানের পাশাপাশি এতে যুক্ত ছিল জাতীয় কবির কালজয়ী সৃষ্টির বিজাতীয় অবমাননার প্রতিবাদ। অনুষ্ঠানে স্মরণ করা হয় প্রয়াত কবি আবু বকর সিদ্দিককে। অনুষ্ঠানে একক কণ্ঠে ‘বিমল আনন্দ জাগোরে’ গানটি গেয়ে শোনান সত্যম কুমার দেবনাথ, ‘তোমার সুর শুনায়ে’ গানটি পরিবেশন করেন তানিয়া মান্নান, ‘মির দুয়ার খোলো’ গেয়ে শোনান এ টি এম জাহাঙ্গীর, ‘অধরা দিল ধরা এ ধুলার ধরণীতে’ পরিবেশন করেন শারমিন সাথী ইসলাম ময়না ও চন্দনা মজুমদারের কণ্ঠে গীত হয় ‘মনেরে আর বোঝাই কতো’। অনুষ্ঠানে সম্মিলিত কণ্ঠে শিল্পীরা গেয়ে শোনান ‘উদার অম্বর দরবারে তোরি’, ‘ওঠো ওঠো রে’, ‘এ পথ গেছে কোন খানে’, ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’, ‘নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম’, ‘বিপ্লবেরই রক্তরাঙা ঝান্ডা ওড়ে আকাশে’, ‘নাই নাই ভয়’ ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’, ‘আঁধার রজনী পোহালো’ ইত্যাদি গানগুলো। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় পাঠ করে শোনান ‘ত্রাণ ও অপমানিত’ এবং রামেন্দু মজুমদার পাঠ করেন ‘জীবন-বিজ্ঞান’। নববর্ষ কথন পাঠ করেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী। যথারীতি জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন।

চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা : ‘আমরা তো তিমির বিনাশী’ স্লোগানে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-কে বরণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। বরাবরের মতো এবারের শোভাযাত্রায় ছিল লোকজ মোটিফ, নানা ধরনের প্রাণী ও মুখোশ। পয়লা বৈশাখের সকাল সোয়া ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় এ শোভাযাত্রা। এতে নেতৃত্ব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল। আরও অংশ নেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ। যে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে তিন স্তরের নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ছিল শোভাযাত্রাটি। নীলগাই, মাছ, বাঘ, হাতি, টেপা পুতুল, মা-শিশু, প্যাঁচার কাঠামো ও বিভিন্ন ধরনের মুখোশ নিয়ে এতে অংশ নেয় চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ এই শোভাযাত্রা চালু করে। প্রথমদিকে এটির নাম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ থাকলেও পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এটির নামকরণ করা হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে স্বীকৃতি পায়।

শিল্পকলা একাডেমি : পুঁথি পাঠ, লালন সংগীত, নৃত্য ও ঢাকের তালে বর্ষবরণ উদযাপন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। বেলা ১১টায় একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় নববর্ষ বরণের এ আয়োজন। এতে প্রধান আলোচক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদ। সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্বের পর শুরু হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। শুরুতেই সমবেত সংগীত ‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে’, পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিশু সংগীত দল। এরপর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে নাচের দল স্পন্দন। আরও দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পকলা একাডেমির প্রতিশ্রুতিশীল নৃত্য দল। এতে আরও ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বিশেষ পরিবেশনা কালচারাল হ্যারিটেজ। অনুষ্ঠানে ‘আমরা সুন্দরের অতন্দ্র প্রহরী’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পকলা একাডেমির শিশু নৃত্য দল। অনুষ্ঠানে আরও ছিল পুঁথি পাঠ ও লোকসংগীত। সব শেষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিশু সংগীত দল পরিবেশন করে সমবেত সংগীত ‘এসো হে বৈশাখ এসো, এসো’।

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী : বাংলা নববর্ষ বরণের আয়োজনের সময় সংকোচন করা সরকারের সিদ্ধান্ত মানেনি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সময় সংকোচনের প্রতিবাদে ‘বর্ষবরণ মানে না শৃঙ্খল’ শীর্ষক প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সংগঠনটি। সরকার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরপরই সন্ধ্যা ৬টায় শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে শুরু হয় উদীচীর অনুষ্ঠান। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি হাবিবুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের শুরুতেই সময় সংকোচনসহ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি ছোট নাটিকা পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এরপর একক সংগীত পরিবেশন করেন হাবিবুল আলম, হরেকৃষ্ণ দেবনাথ এবং সাজেদা বেগম সাজু। কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, কয়েক বছর ধরেই বর্ষবরণ উৎসবকে নির্দিষ্ট সময়ের ঘেরাটোপে বেঁধে দেওয়ার একতরফা পদক্ষেপ নিয়ে আসছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও সারা দেশে আয়োজিত পয়লা বৈশাখের সব উন্মুক্ত অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শেষ করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু উদীচী মনে করে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপে হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাছে নির্জলা আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুই নয়। এর মাধ্যমে পক্ষান্তরে আবহমান বাংলার সংস্কৃতিবিরোধী অন্ধকারের শক্তিকেই আস্কারা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের অযাচিত সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। তাই এর প্রতিবাদে পয়লা বৈশাখ সন্ধ্যা ৬টায় ‘বর্ষবরণ মানে না শৃঙ্খল’ শিরোনামে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে উদীচী। এ ছাড়া সারা দেশে উদীচীর আয়োজনে সমমনা সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যে বর্ণাঢ্য বর্ষবরণ উৎসব হয় তা-ও যথা নিয়মেই আয়োজন করা হয় বলে জানান অমিত রঞ্জন দে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর